ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক, পঞ্চম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
500

ভোরের ট্রেনের প্যাসেঞ্জারের সোরগোলে পটলের ঘুম ভেঙ্গে গেল । বোন তখনও ঘুমাচ্ছে । পটল ঘুম থেকে উঠে বোনকে আর বিরক্ত করলো না । বোনটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক ! বোনকে রেখে প্রাতঃকালীন কাজ সারতে পটল প্লাটফর্মের শৌচালয়ে ছুটলো ।
ইতিমধ্যে ভোরের ট্রেন, আজিমগঞ্জ-কাটোয়া, প্লাটফর্মে হাজির । ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় । শব্জি বিক্রি করার মাসিরা বস্তা বোঝাই শব্জি নিয়ে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে । কৃষি কাজের দিনমজুরেরা হাতে একটা বাজার করার ছোট ব্যাগ নিয়ে কামরায় বসা । ছোট ব্যাগে নিড়ানি, কাস্তে, খাবারের টিফিন, ইত্যাদি নিয়ে সালার চলল কাজের সন্ধানে । সালার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন । এই সালার থেকে ভরতপুর’সহ অনেক গ্রাম-গঞ্জ কভার করা যায় । যার জন্য চাষিদের টার্গেট থাকে সালারের দিকে কাজের সন্ধানে যাওয়ার । যারা ফ্লাট বাড়ি নির্মাণের কাজে রাজমিস্ত্রি ও রাজমিস্ত্রির যোগাড়ে, তারা ট্রেনের কামরার সিটে বসা । বেশীর ভাগ ট্রেনযাত্রী দৈনিক দিনমজুর । সকলেই কাজের ধান্দায় সালার, ঝামটপুর-বহরান, টেঁয়া, ইত্যাদি জায়গায় ছুটছে । কৃষি জমিতে এইসব খেটে খাওয়া প্যাসেঞ্জারের কাছে বৈধ টিকিট আছে কিনা সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে ভোরের ট্রেনটায় দৈনিক দিনমজুরের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশী ।
ট্রেনের কামরার ভিতরটা ভিড়ে ঠাসা । অত ভোরে ট্রেনের কামরায় প্যাসেঞ্জারের অবস্থা দেখলে সহজেই অনুমেয়, এলাকার মানুষের দরিদ্রতা লাগামছাড়া । নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে কাজের সন্ধানে তাদের অন্যত্র ছোটা । যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ট্রেন । কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের ক্ষেত্রেও ট্রেন একমাত্র ভরসা । এছাড়া সোমবারদিন ট্রেনে ভিড় বেশী । কারণ সপ্তাহের প্রথমদিন ভোরের ট্রেনে সপ্তাহন্তে শনিবারদিন যারা চাকরিস্থল থেকে বাড়ি এসেছিলেন তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন । তাঁরা শনিবার কলকাতার কর্মস্থল থেকে বাড়িতে আসেন এবং সোমবার ভোরের ট্রেনে কর্মস্থলে ফিরে যান । ট্রেনের কামরায় প্যাসেঞ্জার ছাড়া রয়েছে অনেক হকার । হকারদের চিৎকার, “চা চাই, চা !” তবে যে কয়েকজন হকার সকাবেলায় পাউরুটি ও কলা নিয়ে ট্রেনের কামরায় হকারি করে, তারাই বিকেলে বা সন্ধ্যারাত্রিতে পাউরুটি ও ঘুগনি বিক্রি করে । হকারদের বিভিন্ন রকমের খাবারের হকারি ব্যবসা । কেউ ছোলা সেদ্ধ, কেউ মুড়ি-মাখানো, কেউ চিড়ে-ভাজা, কেউ পাকা কলা, ইত্যাদি বিক্রি করে । তবে ভোরবেলায় চা ও পাউরুটি জনপ্রিয় । সুতরাং ভোরের ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের দেখলে এলাকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে কিছুটা অবগত হওয়া যায় ।
বাজারসৌ স্টেশন থেকে ভোরের ট্রেনটি ছাড়লো ।
প্লাটফর্ম ফাঁকা । পরের ট্রেন দেরীতে । এদিকে এতক্ষণ প্যাসেঞ্জারদের কল-কোলাহল ও ট্রেনের হুঁইশালের জন্যে ঝিঙের ঘুম ভেঙ্গে গেছে । চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ট্রেনটি প্লাটফর্ম ছেড়ে কাটোয়ার দিকে ধাবিত । প্লাটফর্ম ফাঁকা । ঘুম থেকে উঠেই চোখ রগড়াচ্ছে ঝিঙে । চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তার পাশে দাদা নেই । দাদাকে না দেখতে পেয়ে আচমকা ভয় পেয়ে গেল ঝিঙে ! তার সাথে দাদা শুয়ে ছিল । কিন্তু এত ভোরে কোথায় গেল ? আতঙ্কে ঘাবড়ে যাওয়ার মতো ঝিঙের মনের পরিস্থিতি । তবে কী দাদা বিপদে পড়লো ? দাদার বিপদের কথা ভেবে ঝিঙের মুখ শুকিয়ে কাঠ্‌ ! শুরু হল কান্না ! ফাঁকা প্লাটফর্ম । ভোরের আলো সেভাবে ফুটে ওঠেনি । সূর্য উঠতে দেরী । আকাশে চাঁদ নেই । যার জন্য তখনও অন্ধকার । প্লাটফর্মের বিজলি বাতি স্টেশন মাস্টারের অফিস ঘেঁষে দুখানা । আর বাকীগুলি খারাপ । সেগুলি সারানোর অভাবে বাতি জ্বলছে না । তাই ভয় পেয়ে ঝিঙের কান্না শুরু ! কান্নার পারদ ক্রমশ বাড়ছে । সমস্ত প্লাটফর্মে তার কান্নার রোল ঘুরপাক খাচ্ছে । পটল পায়খানায় বসে বোনের ক্রন্দন শুনতে পেয়ে তার প্রাতঃকালীন কাজ অসমাপ্ত রেখে বোনের কান্না থামাতে ছুটে এল । তারপর দাদাকে দেখতে পেয়ে ঝিঙের নিশ্চিন্তি । মুখে তার খুশীর বাতাবরণ ।
প্লাটফর্মের টিউবওয়েলে গিয়ে পটলা বোনের হাত মুখ ধুইয়ে দিলো । ঐদিকে পূর্ব আকাশে সূর্যের উঁকি । বাজারসৌ স্টেশন সূর্যের আলোয় আলোকিত । কিছুক্ষণ পর শুরু হবে ভ্যাপসা গরম । কিছুদিন ধরে বৃষ্টি নেই । ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশও রুক্ষ । এরপর পটলকে বের হতে হবে নোনাই নদীর বাঁধে কাজে যাওয়ার জন্য । তাই বোনকে নিয়ে পটল চলল রহমানের দোকানে । রহমান সকাল বেলায় আটার রুটি ও ঘুগনি বানায় ।
দোকানে পৌঁছে ঝিঙে বলল, “রহমান চাচা, আমাদের তিনটে করে রুটি ও ঘুগনি দাও ।“
রহমান চাচা চটজলদি একটা ছোট থালায় তিনটি আটার রুটি ও ঘুগনি ঝিঙেকে দিয়ে বলল, “আজকের ঘুগনিটা তোমার খুব পছন্দ হবে ।“
ঝিঙে হেসে বলল, “কেন বহড়ান চাচা ?”
তুমি গতকাল ঘুগনির সাথে পেঁয়াজ কুচি ও লেবুর রস চেয়েছিলে । আজ সেটা ঘুগনিতে আছে । তুমি খেলে সেটা বুঝতে পারবে ।
খাওয়া শুরু করলো ঝিঙে । তিনটে রুটি খেতে না পেরে একটা রুটির অর্ধেক অংশ দাদার থালায় তুলে দিলো । তারপর ঢক ঢক করে জল । দুজনের খাওয়ার পর নোনাই নদীর বাঁধের দিকে তাদের যাত্রা ।
গদাই খুড়ো পটলকে দেখামাত্র খেঁকিয়ে উঠলেন, “কাজে এত দেরীতে পৌঁছালে চলবে না । সকাল আটটার মধ্যে হাজিরা না দিলে সেদিন কোনো কাজ পাবে না । দেরীতে আসা আজ তোমার প্রথম দিন, তাই ছেড়ে দিচ্ছি । ভবিষ্যতে আর কোনোদিন দেরী করলে তোমাকে কাজ থেকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে । কথাটা মাথায় রেখো ।“ তারপর আবার বললেন, “মনোহরের টীমে তোমার দেরী দেখে অন্য লোক দিয়ে দিয়েছি । এইদিকে স্লুইস গেট মেরামতির কাজ চলছে । তপাদার রাজমিস্ত্রী স্লুইস গেটে সিমেন্ট-বালি দিয়ে মেরামতির কাজ করছে । তুমি তার অধীনে যোগাড়ের কাজ করো । চলো আমি তাকে বলে দিচ্ছি ।“
তুলনামূলকভাবে রাজমিস্ত্রীর যোগাড়ের কাজ পটলের কাছে সহজ । তিনজন রাজমিস্ত্রী মেরামতির কাছে নিয়োজিত । পটলের সঙ্গে আরও তিনজন যোগাড়ের কাজে কর্মব্যস্ত । তাদের কাছে শিখে নিচ্ছে, কত কড়াই বালির সঙ্গে এক কড়াই সিমেন্টের মিশ্রণ ! সেই মোতাবেক পটলা ইট গাঁথার মশলা তৈরী করছে । অদূরে ঝিঙে বাঁধের উপর বসা । নোনাই নদীর জলের দিকে তাকিয়ে ঝিঙে ছোট ছোট মাটির টুকরো জলে ছুড়ে মারছে । তাতেই তার আনন্দ ।
ঠিক বেলা দেড়টার সময় বাঁশির হুইস্‌ল । দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় । সবাই কাজ থামিয়ে বাঁধে এসে দাঁড়ালো । সকলে গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে । তারপর যার যার টিফিন কৌটা খুলে বাঁধের উপর গোল হয়ে বসলো । কয়েকজন তাদের খাবার ভাগাভাগি করে খেতে থাকলো । কিন্তু পটলা ও ঝিঙে ? তাদের কাছে খাবার নেই । তাই তারা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে নোনাই নদী ঘেঁষে রাধানগর গ্রামে পৌঁছালো । মুদিখানার দোকান থেকে দু-শত গ্রাম মুড়ি কিনে দুই ভাই-বোনে রাস্তার পাশে বেল গাছ তলায় বসলো । মুড়ি খেতে খেতে ঝিঙে হঠাৎ বলল, “দাদা, আমি কাঁচা লঙ্কা নিয়ে আসি ।“
কাঁচা লঙ্কা ! কিন্তু কাঁচা লঙ্কা কোথায় পাবি ?
হেঁটে আসার পথে একটা বাড়ি লাগোয়া কাঁচা লঙ্কা গাছ দেখেছি । বাড়ির লোকের কাছ থেকে চেয়ে দুটো লঙ্কা ছিঁড়ে শীঘ্র ফিরবো । কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মুড়ি খাওয়াটা জমবে । আর তা ছাড়া ঝাল লাগলে মুড়িও তাড়াতাড়ি শেষ হবে ।
বাড়ির লোককে জানিয়ে লঙ্কা ছিঁড়বি । কিন্তু তাঁরা বাঁধা দিলে সোজা ফিরে আসবি ।
“ঠিক আছে দাদা ।“ মাথা নেড়ে ঝিঙে ছুটলো লঙ্কা আনতে ।
“দুটো কাঁচা লঙ্কা ছিঁড়তে চাই দিদিমা ?” ঝিঙে বাড়ির বয়স্কা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলো ।
“দুটো কেন ? তোমার যা লাগে নিয়ে যাও বাছা । বাড়িতে লাগানো কাঁচা লঙ্কা গাছ । এবার ফলন ভাল ।“ তারপর ঝিঙের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা বাছা ! তোমাকে তো চিনতে পারলাম না ?”
দিদিমা, আমরা মুড়ি কিনেছি । কাঁচা লঙ্কা দিয়ে খাবো ।
এইটুকু বাচ্চা ! তোমাদের ঘর কোথায় ?
ঘরের কথা শুনে ঝিঙের চোখ ছল ছল ।
ঝিঙের চোখ ছল ছল দেখে বয়স্কা মহিলা সহৃদয়তার সাথে নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার সাথে কে এসেছে বাছা !”
“দাদা । বেল গাছের নীচে বসে মুড়ি খাচ্ছে ।“ হাত দিয়ে দাদাকে দেখিয়ে দিলো ঝিঙে ।
বয়স্কা মহিলা এগিয়ে এসে ঝিঙেকে অনেকগুলি লঙ্কা নিজের হাতে ছিঁড়ে দিতে গেলে সে বেঁকে বসলো । তাদের বাড়ি ঘর কিছু নেই, সুতরাং লঙ্কা নিয়ে রাখার জায়গা নেই । তাই শুধুমাত্র চারটে লঙ্কা নিয়ে দাদার কাছে ছুট্‌ । বয়স্কা মহিলা এক দৃষ্টে ঝিঙের দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
দিনের শেষে মনোহর পটলকে খুঁজে বার করলো । দুই ভাই বোনের খোঁজ খবর নিলো । ইতিমধ্যে পটল দিনের মজুরি হাতে পেয়ে গেছে । মনোহর বলল, “তোমরা এভাবে কতদিন স্টেশনের প্লাটফর্মে জীবন কাটাবে । কোথাও একটা ঘর বানাবার চেষ্টা করো । নতুবা সামনে বর্ষাকাল । বর্ষাকালে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানো খুব মুশকিল হবে ।“ রাধানগর গ্রামে ঘর বানিয়ে বাস করার পরামর্শ দিলো মনোহর । রাধানগরে কিছুটা জমি অচাষযোগ্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে । এখনও পর্যন্ত সেই অনাবাদি জমির কোনো দাবিদার নেই । সুতরাং সেই জায়গার উপরে অন্তত তালপাতার ছাউনীর ঘর তুলে তারা দিব্যি বাস করতে পারে । কেউ বাঁধা দেবে না । ঠাণ্ডা মাথায় এসব কথা শুনে মাথা নেড়ে বিদায় নিলো পটলা ও ঝিঙে ।
বাজারসৌ স্টেশনে তাদের পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রির অন্ধকার । আবার সেই ঝুঁপড়ির মধ্যে জগাইয়ের ভাতের হোটেলে । হোটেলে গিয়ে জানতে পারলো, খাওয়ার ভাত নেই । শুধুমাত্র ডাল ও বাটা মাছের ঝোল পড়ে রয়েছে । পটল কপালে হাত দিয়ে বলল, “সর্বনাশ ! আমার বোন খাবে কী ?”
জগাই ঝিঙের দিকে তাকিয়ে দেখলো, বাচ্চা মেয়েটা তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে ! ঝিঙের তাকানো দেখে জগাইয়ের হৃদয় বিষণ্ণতায় ভরে গেল । বুকের ভিতর তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার মুখটা ভেসে উঠলো । জগাইয়ের চোখ তখন ছল ছল ! ঝিঙের করুণ মুখটা দেখে জগাইয়ের হৃদয় বিগলিত হয়ে উঠলো । পটলের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাছা ! তোমরা দশ মিনিট অপেক্ষা করো । আমি এক্ষুণি হাঁড়িতে ভাত বসাচ্ছি । উনুনে যথেষ্ট আগুনের তেজ । মুহূর্তের মধ্যে ভাত রান্না হয়ে যাবে । তারপর গরম গরম ভাত খেতে পারবে ।“
কয়লার উনুনে হাত পাখার হাওয়া দিয়ে আগুনের তেজ আরও বাড়িয়ে দিলো । ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে ভাত রেডি । ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে গরম গরম ভাত পরিবেশন করলো জগাই । পটলদের ভাত খাওয়ার মাঝখানে জগাই ঝিঙের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, “পেট ভরে ভাত খাবে মা !“
জগাইয়ের মিষ্টিমধুর কথা শুনে পটল বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, “বোনটা অনেকদিন পরে মাছ ভাত পেয়ে পেট ভরেই ভাত খাবে ।“ তারপর জগাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি অহেতুক উতলা হবেন না । আমার বোনটা পেট ভরেই ভাত খাবে ।“
দাদার কথা শুনে ঝিঙের মুখে সুন্দর একটা তৃপ্তির হাসি !
ঝিঙের খুশীর ফোয়ারা দেখে জগাইয়ের চোখে জল ।
পটল জগাইয়ের চোখে জল দেখে উদ্গ্রিব হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি রাত দুপুরে কাঁদছেন কেন ?”
জগাই এবার চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলো না । কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোমার বোনের মতো আমার একটি মেয়ে ছিল । তোমার বোনকে আমি যতবার দেখছি ততবার সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়ের মুখটা আমার হাহাকার অন্তরে ভেসে উঠছে !”
“হারিয়ে যাওয়া” ব্যাপারটা বুঝলাম না ।
আমার মেয়ের বয়স যখন চৌদ্দ বছর, হাই স্কুলে পড়ছিল । পড়াশুনায় খুব ভাল ছিল । আমাদের সবেধন ঐ একটি মেয়ে । তাই মেয়েকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন । সেইজন্য তাকে পড়াশুনার ব্যাপারে কোনো খামতি রাখিনি । আমার মেয়েটার বয়স অনুপাতে চেহারার গঠন হৃষ্টপুষ্ট । কলেজে পড়ার মতো দেখতে । যার জন্য রাস্তাঘাটে লোকের নজরে পড়তো । মেয়ের পেছনে গাঁয়ের উলট পালট ছেলেপুলের জটলা ছিল বটে, কিন্তু তাদের কোনো অভব্য আচরণ ছিল না । মেয়েটা ছিল বাবা মায়ের খুব নেওটা । যাই হোক মেয়েকে নিয়ে অভাবের সংসারে আমরা আনন্দেই কাটাচ্ছিলাম ।
সকলেই জানে, শক্তিপুরের শিবের মেলা বিখ্যাত । গ্রামীণ মেলা । সাতদিন ধরে চলে । বলা চলে শিব চতুর্দশীতে মানুষের মিলন মেলা । মেলাকে কেন্দ্র করে সমস্ত ধর্মের মানুষের সমারোহ । সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর যেমন উচ্চ-নীচ, ধনী-গরীব, সব শ্রেণীর মানুষ ভেদাভেদ ভুলে মেলা উপলক্ষ্যে কয়েকটা দিন আনন্দের জোয়ারে গা ভাসানো । তবে মেলার প্রথম দুদিন খুব ভিড় । মেলায় হৈ-হট্টগোল, চেচামেচি, অহরহ । প্রথম দুদিন মেলায় প্রচণ্ড ঠেলাঠেলি । ধাক্কাধাক্কি । ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভিড় চোখে পড়ার মতো । দূর দূরান্ত থেকে লোকজন মেলা দেখতে আসে । মেলায় হরেক রকমের দোকান । খাদ্য খাওয়ার দোকান ছাড়াও কাপড় বা পোশাক পরিচ্ছদ, পুতুল, সাজগোঁজের জিনিসপত্র, নাগর দোলা, পুতুল নাচ, বানরের নাচ, মাটির জিনিস, কাঠের জিনিস, অসংখ্য ধরনের জিনিসপত্রের বেচাকেনা । মেলায় কৃষি ও কুটির শিল্পজাত জিনিসপত্রের সমারোহ উল্লেখযোগ্য । সকলেই জানে মেলার যেমন উপকারিতা আছে তেমনি অপকারিতাও প্রচুর । চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, নারী পাচার, ইত্যাদি । তা ছাড়া দুষ্কৃতকারীদের আনাগোনাও যথেষ্ট ।
মেয়েকে নিষেধ করা সত্ত্বেও গাঁয়ের কয়েকজন বান্ধবীর পীড়াপীড়িতে মেলার প্রথমদিনেই মেলা দেখতে ছুটল । আমার গিন্নি পইপই করে মেয়েকে নিষেধ করেছিল, তবুও গিন্নির কথা মেয়েটা শুনলো না । তারপর জগাই থামলো । তার চোখে জল । তার চোখের জল থামানো যাচ্ছে না । মেলা থেকে মেয়েটার সব বান্ধবী বাড়ি ফিরলো, কিন্তু আমার মেয়েটা আর বাড়ি ফিরলো না । সকল অধিবাসীর অনুমান মেয়েটা নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে ভিন রাজ্যে পাচার হয়ে গেছে । অনেক খোঁজাখুজি, তল্লাসি, থানা-পুলিশ কোনো কিছুতেই মেয়েটাকে আর ফেরত পেলাম না । তারপর জগাইয়ের হাউ হাউ করে কান্না !
পটল বোনটাকে খুব শক্ত করে ধরে প্লাটফর্মে শুয়ে পড়লো । জগাইয়ের মেয়ের অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শুনে পটল ঝিঙেকে নিয়ে বাজারসৌ স্টেশনে থাকা আর নিরাপদ ভাবলো না । শীঘ্রই তাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে । নতুবা বিপদে পড়ার সম্ভাবনা ! যত জগাইয়ের মেয়ের কথা পটল ভাবছে ততই বোনের জন্য তার চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে । বোনটাকে পাশে নিয়ে শুয়ে পড়লো বটে কিন্তু তার ঘুম আসছে না । অন্যদিকে ঝিঙে বুঝতে পারলো দাদা জেগে রয়েছে । ঝিঙে শোওয়া থেকে উঠে দাদার চোখে হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে বলল, “ঘুমিয়ে পড়ো দাদা, অনেক রাত হয়েছে ।“
 (চলবে)