আশ্চর্য আকাশের আয়নাঃ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত : অনুভবে, শুভঙ্কর দাস।

0
1399

এমন আশ্চর্য আকাশের মতো আয়না, শুধু থেকে গেছে বাংলায়,পৃথিবীর আর কোথাও নেই!!

“আমাদের এ জীবন!জীবনের বিহ্বলতা সয়ে
আমাদের দিন চলে,আমাদের রাত্রি তবু চলে,
তার ছিঁড়ে গেছে,তবু তাহারে বীণার মতো ক’রে
বাজাই,যে প্রেম চলিয়া গেছে তারি হাত ধরে!
কারণ,সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের থেকে,
প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি,তাই রাখিয়াছে ঢেকে
পাখির মায়ের মতো প্রেম এসে আমাদের বুক
সুস্থ করে দিয়ে গেছে আমাদের রক্তের অসুখ!”—

অনুভবের যাত্রাপথ শুরু করলাম আত্মমগ্ন কবি জীবনানন্দের ‘প্রেম’ কবিতার চরণ দিয়ে।আমাদের রক্তের অসুখ কী? মাত্র তিনটি শব্দ খরচ করলেই সমগ্র অন্ধকারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে,ঈর্ষা, অবিশ্বাস এবং অশ্রদ্ধা।
এগুলো সংসারে-সমাজে-রাষ্ট্রনির্মাণে দুরারোগ্য ব্যাধির মতো চেপে বসলেই,আরও তিনটি উপসর্গ একদম ফ্রি-তে হাজির হয় এবং তবলার তালের মতো বাজতেই থাকে ধ্বংসে-নষ্টামিতে ও নোংরামিতে,তা হল ইগো,আঁতলেমি এবং সবজান্তাগিরি।
এর থেকে মুক্তি চাই,পরিত্রাণ চাই,কারন “সূর্যের চেয়ে,আকাশের নক্ষত্রের থেকে প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি;”
এই প্রেম আসলে কী?
এই প্রেম হল অমলা, অহেতুক এবং অবিনিময়।
এ আবার কীরকম? আসলে আমাদের প্রেম স্বার্থের নরক দিয়ে ঘেরা,যার সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত মুখোশ দিয়ে মুগ্ধ করার প্রয়াস,সারাজীবন অভিনয়ের ফ্যাশান,প্রসাধনী বিলাসিতার বিবর্ণতায় মোড়া।ফলে বুঝতে পারি না, সহজেই।অনুভব করতে পারি না,সকালের আলোয়, এই আমাদের জীবনযাপনে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা!
আমরা কেউ কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসি না!যদি সত্যিকারের ভালোবাসা বা প্রেম হত,তা হত নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত এবং নিমগ্ন সুন্দর। এমন ভাব মনে হত, সে আমাকে ভালোবাসুক বা না বাসুক,আমাকে গ্রহণ করুক, বা প্রত্যাখ্যান করুক,পুরস্কার দিক, বা তিরস্কার, সুরে বাঁধুক বা দূরে ঠেলে দিক,তাকে অন্তর থেকে আজীবন ভালোবেসে যাব।এবং প্রয়োজন পড়লে তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকব।
এই প্রেম বা ভালোবাসা কোথায়? একেবারে যে আমাদের মধ্যে নেই,তা বলছি না!কিন্তু নিখাদ নিমগ্ন ও নিরাময় হয়ে ওঠে এমন প্রেমের সন্ধান কোথায়?
এইখানে একটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করব,নত মস্তকে,তা হল,”শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত।”রচনাকার শ্রীম।
এই ধরণের আশ্চর্য আলো ও অনুভবের গ্রন্থ শুধু বাংলায় কেন, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে একান্ত দুর্লভ।
এই গ্রন্থের সমালোচনা করার মতো বোধ বা বিশ্লেষণ করার মতো যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই,তাই সেরকম কোনো রূপ ধৃষ্টতা দেখানোর মূর্খামি আমি করতে বসিনি।আমার এই বইটি পড়ে বিস্ময় ও বিহ্বলতা জেগেছে,তাই আপনাদের সঙ্গে শুধু সহজিয়া স্বরে আলোচনা করে নিচ্ছি। তার বেশি কিছু নয়।আমি এটাও ভালো করে জানি,এমন কোনো সুশিক্ষিত বাঙালি পরিবার নেই,যাঁদের গৃহে এই অমৃতগ্রন্থটি নেই!
এখন এই অমৃতগ্রন্থের একটি সহজ পরিক্রমা করছি।

এই গ্রন্থটির প্রধান মুখ ও আলো শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর জীবন ও বাণী তাঁরই মুখ থেকে আমরা সরাসরি শুনতে পাই এবং পড়তে পাই।তাঁর সম্বন্ধে শ্রীরাজাগোপালাচারী বলেছেন,” কোনো মহর্ষি যখন কথা বলেন,তখন শুধু তাঁর বুদ্ধি নয়,সমগ্র জীবনটাই কথা বলে।তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণ যখন কথা বলেন,তখন ভারতবর্ষের যত মুনি ঋষি আছেন সবাই তাঁর মধ্য দিয়ে কথা বলেন। স্মরণাতীত কাল থেকে ভারতের যে সঞ্চিত জ্ঞানভান্ডার তারই মূর্তরূপ শ্রীরামকৃষ্ণ। ”
ম্যাক্স মুলার বলেছিলেন,শ্রীরামকৃষ্ণ শুধু হৃদয়বান এবং প্রকৃত মহাত্মা ছিলেন না,একজন মৌলিক চিন্তাবিদও ছিলেন।”
টলস্টয় বলেছিলেন,অসাধারণ মহাজ্ঞানী “।
রঁম্যা রোলাঁ বলেছিলেন ” ভারতবর্ষের সমবেত জ্ঞান ও বিশ্বাস”।
এবং অল্ডাস হাক্সলে বলেছিলেন,জীবনী সাহিত্যে এরকম বই আর নেই,কোনো দেশে,কোনো ভাষার সাহিত্যে আমি এ রকম বই আর দেখিনি”।

এইসব মতামত প্রায় সবই “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত” পাঠের মূল্যবান প্রতিক্রিয়া। তাহলে বুঝতে পারি এই গ্রন্থ এবং একজন আলোকপুরুষ কীভাবে মানুষের চোখে এক হয়ে দেখা দিয়েছেন।
অথচ শ্রীরামকৃষ্ণ এর জীবন ও বাণীর ওপর কম গ্রন্থ লেখা হয়নি!একটা ছোট্ট বিবরণ—
শ্রীরামকৃষ্ণের নাম প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়,’ইন্ডিয়ান মিরর’ সংবাদপত্রে।১৮৭৫ সালে।
‘ধর্মতত্ত্ব’ পত্রিকায় তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী প্রকাশিত।
বাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন ‘পরমহংসের উক্তি’ নামে শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশাবলী প্রকাশ করেন।১৮৭৮ সালে।
সুরেশচন্দ্র দত্ত লেখেন ‘পরমহংসের উক্তি’।১৮৭৯ সালে।
গিরিশচন্দ্র সেন লেখেন”পরমহংসের উক্তি ও সংক্ষিপ্ত জীবন”
অক্ষয়কুমার সেন লেখেন,”শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি” ১৯০১ সালে।
স্বামী সারদানন্দ লেখেন “শ্রীশ্রীরাকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ”
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল লেখেন,”শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃত”।
এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব মেকি প্রচার এবং বোধহীন লেকচারকে প্রচন্ড ঘৃণা করতেন।তাই কেউ না বুঝে,না বোধ তৈরি করে গালভরা প্রসংশা বা নিন্দা করলে তিনি সহাস্যে বলতেন,লোক না পোক,অর্থাৎ পোকা।এইভাবে প্রচার করার জন্য তিনি সেইসময়ের “Cynosure of the neighbouring eyes” কেশবচন্দ্র সেন,যিনি অসাধারণ বাগ্মী ও সমাজ-অধিপতি,তাঁকে বকে দিয়েছিলেন।কেশবচন্দ্র সেন নিজেই শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নিবেদন করেন,যদি আদেশ দেন তাহা হইলে আপনার কথা সাধারণের নিকট প্রকাশ করিয়া দিই,তাহাতে বহুলোকের উপকার হইবে।”
তাতে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবস্থায় বলে ওঠেন,এর মধ্যে যে ভাব আছে,যে শক্তি আছে এখন প্রচার করিবার প্রয়োজন নাই,একে বক্তৃতা বা খবরের কাগজের দ্বারা প্রকাশ করিতে হইবে না।এর মধ্যে যে শক্তি আছে,যে ভাব আছে,তাহা যখন বাহির হইবার সময় হইবে,তখন আপনা আপনি তাহা চর্তুদিকে ছড়াইয়া পড়িবে।”

একথা যে চরম সত্যি,তা কালের নিরিখে প্রমাণিত হয়েছে,তা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না! আর একটি ভয়ংকর সত্য এই কথায় উঠে এসেছে,’সময় না হলে কিছুই হবে না।’
এই সময়ের বিস্ময়কর যাত্রা এবার দেখব।তা হল “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত” এর জয়যাত্রার সময়কাল।এ কথা সত্যি এই গ্রন্থের প্রভাব ও বিস্তৃতি পরমহংসদেবের কথাকে পরমীয় করে তুলেছিল এবং এখনও করে তুলছে।পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান ভাষায় এই গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে

শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে শ্রীম অর্থাৎ শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্তের সাক্ষাৎ হয় ১৮৮২ সালে।তখন ঠাকুরের বয়স ৪৬ আর শ্রীম র বয়স ২৭।
আশ্চর্যের বিষয় এই, প্রায় পাঁচ বছরের মতো শ্রীম ঠাকুরের সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন,আর কথামৃত প্রকাশিত মোট পাঁচটি খন্ড। জানা যায়,শ্রীমর কাছে যেসব উপাদান ছিল,তাতে আরও পাঁচ-ছয় খন্ড বের করা যেত। কিন্তু তিনি এমনভাবে লিখতেন,যা,কেবল তিনিই উদ্ধার করতে পারতেন।তাঁর মৃত্যুর ফলে সেই কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।এবং বিস্ময়ের এই পঞ্চম খন্ড প্রকাশের বছরই তিনি দেহত্যাগ করেন।
শ্রীম যে এই অমৃত গ্রন্থের বহনকর্তা হবেন,এ যেন ঠাকুর জানতেন।তাই একটি ঘটনায় দেখা যায়,স্বামী শিবানন্দ একবার ঠাকুরের কথাবার্তা সব গোপনে লিখতে আরম্ভ করেছিলেন।ঠাকুর বা শ্রীম সেসব জানতেন না।কিন্তু ঠাকুর নিজে থেকেই একদিন শিবানন্দকে বললেন,”তোমার ওসব কিছু করতে হবে না।তোমাদের জীবন আলাদা।”
এই একই কাজ শ্রীম করতেন,তাঁকে কিছু বলতেন না।বরং কোনো ধর্মোপদেশ বা সাধনকথা বলার পর শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমকে জিজ্ঞেস করতেন,বুঝেছ তো?
শ্রীম হাসিমুখে ঘাড় নাড়লে,ঠাকুর অতি নিশ্চিন্ত হতেন।
যে লোক শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃত লিখে জগৎ বিখ্যাত হলেন,তিনি কিন্তু প্রথম জীবনে সুখী ছিলেন না।পারিবারিক জীবন এতখানি দুর্বিষহ ছিল যে,তিনি আত্মহত্যা করতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন।সমাজ-সংসার, এমন কি বিদ্যাসাগরের স্কুলের হেডমাস্টারগিরি সব তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল, সেই সময় তাঁর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ এক নবজন্মলাভের সমান। আর যিনি নিজেই একদিন অশান্তি ও অনলে পুড়ে মরতে গিয়েছিলেন,তিনিই হয়ে উঠলেন,পরম শান্তির স্রষ্টা। তিনিই হলেন এমন এক গ্রন্থের রচনাকার,যার প্রতিটি পাতা সুশীতল সবুজ বৃক্ষের ছায়া।এও এক আশ্চর্য!

শ্রীরামকৃষ্ণ তিরোহিত হন ১৮৮৬ সালে।তার প্রায় ষোলো বছর পর শ্রীম রচিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ এর প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়।তখন ১৯০২ সালের মার্চ মাসে।
প্রকাশিত হওয়া মাত্র এই গ্রন্থ বিপুল আলোড়ন ফেলে দেয়।এই একই সালে বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, রবীন্দ্রনাথের ‘নৈবেদ্য’, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ এবং অমৃতলালের ‘অবতার’ নাটক প্রকাশিত।
সেই নৈবেদ্য কাব্যে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন—
“বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ!এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়”

এ যেন সেই অমৃতগ্রন্থের বসুধার জয় করার সূচনাশঙ্খ।দুঃখের বিষয় এই,এই সালেই স্বামী বিবেকানন্দ মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন জুলাই মাসে।অর্থাৎ তিনি কথামৃতের একটি খন্ড ছাড়া আর কোনো খন্ড দেখে যেতে পারেননি!আবার পড়ি রবীন্দ্রনাথের ‘নৈবেদ্য ‘,তাতে তিনি ‘প্রার্থনা’ কবিতায় লিখলেন—
“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত,যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি”

এখানেই যেন সেই মহাজীবনময় আনন্দময় সন্ন্যাসীর দুঃসাহসিক অভিযান এবং অপরিমেয় বিস্ময়কর জীবনকে চরণে চরণে উপলব্ধি করতে পারি,যেন সেই সন্ন্যাসীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশিত “তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা”

এও এক হৃদয় প্রকাশের উদ্বুদ্ধ আকাশ।কোথাও যেন ভারতবর্ষ নানা রূপে ও নানাভাবে এক হয়ে এক সুবৃহৎ সুশীতল বৃক্ষ হয়ে উঠতে চাইছিল।
সংঘজননী শ্রীমা সারদা তখন জয়রামবাটীতে অবস্থান করছেন।তাঁর বয়স ৪৯.
আর প্রথম ভাগে এক জায়গায় শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—-
“কথাটা এই,ঈশ্বরকে ভালোবাসতে হবে।মা যেমন ছেলেকে ভালোবাসে,সতী যেমন পতীকে ভালোবাসে,বিষয়ী যেমন বিষয় ভালোবাসে,এই তিনজনের ভালোবাসা,এই তিন টান, একত্রে করলে যতখানি হয়,ততখানি ঈশ্বরকে দিতে পারলে তাঁর দর্শন লাভ হয়।”
আশ্চর্য কথামালা!

এরপর ১৯০৪ সালে দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশ।মা সারদা কলকাতার বাগবাজারে এক ভাড়াবাড়িতে আছেন।পরে আত্মীয়স্বজন এবং শ্রীমর স্ত্রী-সহ তিনি পুরী গমন করেন।
মহাত্মা গান্ধী ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করছেন,ভারতবর্ষের পরাধীনতার গ্লানি ও কষ্টের নানাদিক তুলে ধরছেন।লর্ড কার্জন ভাইসরয় পদে আবার বহাল হন।কংগ্রেস দল তার বিংশতম অধিবেশন বোম্বাই এ করছে।সভাপতি স্যর হেনরি কট।রবীন্দ্রনাথ ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতাটি রচনা করেন।অন্যদিকে জার শাসিত রাশিয়ার সঙ্গে জাপানের যুদ্ধ লেগে গেছে।
অন্যদিকে এই ভাগে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—
“ঈশ্বর দুইবার হাসেন।একবার হাসেন,যখন দুইভাই জমি নিয়ে বখরা করে আর দড়ি মেপে বলে,এ দিকটা আমার,ও দিকটা তোমার”

কথামৃতের তৃতীয়ভাগ প্রকাশিত ১৯০৮ সালে। এই সময়কাল হল কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সুবর্ণ যুগ।নূরজাহান,সীতা,মেবার পতন একের পর এক অসামান্য নাটক রচনা করছেন এবং তা মঞ্চস্থ হচ্ছে বিপুল জনসমাদরে।অবনীন্দ্রনাথ লিখলেন,ক্ষীরের পুতুল।
সারদাদেবী তখন জয়রামবাটীতে,কিন্তু ভ্রাতাদের কলহ আর কুশ্রী স্বার্থপরতায় নীরব ও নিমগ্ন শ্রীমা কলকাতায় ফিরে আসেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে এক আশ্চর্য বলয়ের মধ্যে বাস করতেন সারদাদেবী।এবং বলা বাহুল্য, এই আত্মশক্তি তিনি ঠাকুরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
এইসময় মজঃফরপুরে কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দেওয়া হয়।আর প্রফুল্ল চাকি নিজেই নিজেকে গুলি মেরে শহীদ হন।এঁদের কথা বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁর ‘কেশরি’ পত্রিকায় বীর বন্দনায় বার বার লেখার জন্য গ্রেপ্তার হন।বক্সার জেল থেকে বিপিনচন্দ্র পাল মুক্ত হলেন,হাওড়া স্টেশনে তাঁকে ১লক্ষের বেশি মানুষ সংবর্ধনা জানান।
এইসালে ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী সুচেতা কৃপালিনীর জন্ম।
আর ইতালি ও সিসিলিতে ভূমিকম্পে ৭৫০০০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে।এখানে এক জায়গায় ভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন—
“ঈশ্বর যাদের ধরে আছেন,তাদের কোনও ভয় নেই।মাঠের আলের উপর চলতে চলতে যে ছেলে বাপকে ধরে থাকে সে পড়লেও পড়তে পারে,যদি অন্যমনস্ক হয়ে হাত ছেড়ে দেয়।কিন্তু বাপ যে ছেলেকে ধরে থাকে সে পড়ে না।”

১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় কথামৃতের চতুর্থ ভাগ।
তখন সারদাদেবী কলকাতা থেকে বলরাম বসুর উড়িষ্যার জমিদারি কোঠারে থাকার জন্য যাত্রা করেন।
প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের ‘খেয়া’ কাব্য এবং নাটক ‘রাজা’
মহাত্মা গান্ধী তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের জন্য আইনি লড়াই করে চলেছেন।
অরবিন্দ ঘোষ গোপনে কলকাতা থেকে চন্দননগর গেলেন এবং বিপ্লবীজীবন পরিত্যাগ করেন।
কাজের সময় সঠিক করার দাবীতে বোম্বাই ও ব্রোচ অঞ্চলের শ্রমিকরা ধর্মঘট করা শুরু করেছেন।
অন্যদিকে কংগ্রেসের ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’ স্থাপিত এবং এর প্রধান হন রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠা ভগিনী স্বর্ণকুমারীদেবীর কন্যা সরলাদেবী চৌধুরানী। এই ভাগের একস্থানে পড়ি,যেখানে ঠাকুর বলছেন—
“অহংকার, উপাধি,এসব ত্যাগ হলেই ঈশ্বর দর্শন করা যায়।’আমি পন্ডিত’ ‘আমি অমুকের ছেলে’,’আমি ধনী’ ‘আমি মানি’ এসব উপাধি ত্যাগ হলেই দর্শন। ঈশ্বর সত্য আর সব অনিত্য, এর নাম বিবেক।”

১৯৩২ সালে কথামৃতের পঞ্চম ভাগ অর্থাৎ শেষভাগ প্রকাশিত।
শ্রীমা সারদা এই খন্ড প্রকাশ দেখে যেতে পারেননি,তিনি ১৯২০ সালে তিরোহিত হন,তখন তাঁর বয়স ৬৭.
মহাত্মা গান্ধী তখন ভারতের ভাগ্যবিধাতা।তিনি হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার অনুশোচনায় অনশন করছেন।রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, মানুষের ধর্ম, কালের যাত্রা এবং পুনশ্চ কাব্য।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন–
“খন্ডতার মধ্যে কদর্যতা,সৌন্দর্য একের মধ্যে। খন্ডতার মধ্যে প্রয়াস,শান্তি একের মধ্যে, খন্ডতার মধ্যে বিরোধ, মঙ্গল একের মধ্যে, তেমনি খন্ডতার মধ্যেই মৃত্যু, অমৃত সেই একের মধ্যে।”
এ সেই অমৃতকথার যেন প্রতিধ্বনি। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলতেন,একের পিঠে একটা শূন্য দাও,দশ হবে।আবার একটা দাও, একশো।এরকম করে দিতে থাকো, সংখ্যা বেড়েই চলবে,আর যদি এক কেটে দাও,তাহলে হাতে থাকবে শূন্য। এক হল ঈশ্বর। ঈশ্বরকে জানার নাম জ্ঞান আর সব অজ্ঞান।
এইসময় একদল আধুনিক কবির পদধ্বনি শোনা যেতে লাগল,প্রকাশিত হল উর্বশী ও আর্টেমিস(বিষ্ণু দে),প্রথমা(প্রেমেন্দ্র মিত্র)।
এই সালে শ্রীম শ্রীরামকৃষ্ণলোকে তিরোহিত হন।
এবং বিশ্বের ক্ষেত্রে এক ভয়ংকর দুঃসংবাদ,জার্মানিতে হিটলার চ্যান্সেলার পদে আসীন হন।
অর্থাৎ আমাদের মতো সহায় সম্বলহীন মানুষের জন্য ধ্বংসের মধ্যে, কষ্টের মধ্যে এবং অনিবার্য মৃত্যুর মধ্যে বেঁচে থাকার একটি আশ্রয় প্রয়োজন ছিল,তা হল এই গ্রন্থ,শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত।
এই ভাগের একস্থানে ঠাকুর বলছেন—-
“কামনা বাসনা থাকলে সকাম ভক্তি বলে!নিষ্কাম ভক্তিকে বলে অহেতুকী ভক্তি।তুমি ভালোবাসো আর নাই বাসো,তবু তোমাকে ভালোবাসি।এর নাম অহেতুকী। ”

সেই অহেতুকী ভালোবাসার আলো তিনি অসময়ে-দুঃসময়ে জ্বালাবার কথা বলেছেন,জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
একটি সহজ প্রশ্ন উঠতে পারে,এই গ্রন্থ বা শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের কী দিয়েছেন?
সহজ উত্তর এই,আমাদের চৈতন্যের পরিপূর্ণতা দিয়েছেন।এই সমাজ-সংসারে কীভাবে সহজিয়া বোধ ও ব্যাকুলতায় বাঁচতে হবে,তার পথনির্দেশ দিয়েছেন।
না,এটি হিন্দু,মুসলিম,খ্রিস্টান বা কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের বই নয়,এটি কোনো একটি জাতি বা দেশের মুখপত্র নয়,এটি মানুষের অন্ধকারে মানুষ হয়ে ওঠার গ্রন্থ। আগামী ভয়ংকর পৃথিবীতে যে গ্রন্থ পথ দেখাবে।বাঁচাবে নিজের মতো আলো নির্মাণ করে।
গ্রন্থটি এভাবে যদি সহজিয়া সুরে সাজাই,তাহলে দেখব,
ঠাকুর কী বলছেন?
—- ঈশ্বরদর্শনই মনুষ্যজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।
—- তাহলে উপায়?
—- ব্যাকুলতা।কাঁদতে হবে তার জন্য। লোকে সম্পত্তি আর সম্মানলাভের জন্য ঘটি ঘটি কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে, তাঁর জন্য কে কাঁদে!
— কিন্তু ব্যাকুলতা তো আসে না!
—- অন্তর শুদ্ধ না হলে ঈশ্বর আছেন বলে বিশ্বাসই হয় না!
—–তাহলে কী আমাদের হবে না?এ জগত কি তাঁর নয়?এসব কি মিথ্যে?
—– জগৎ মিথ্যা কেন হবে? ও সব বিচারের কথা।তাঁকে দর্শন হলে তখন বোঝা যায় যে, তিনিই জগৎ হয়েছেন।
—-তাহলে আর সাধনার করার কি দরকার?ঈশ্বরই তো সবকিছু হয়ে আছেন!
—–দরকার তো,তখন সবই সহজ হয়ে যাবে,সমাজ,সংসার, জগৎ সবের সার সত্য বোঝা যাবে।
—– তাহলে?
—– সর্বদা স্মরণ-মনন।
—– তা তো হয় না!
—- সময় না হলে কিছুই হবে না!

আমরা একজীবনে সেই পরম সময়ের অপেক্ষায় আছি।কারণ জীবনে কখন তা এসে যায়!।স্বয়ং বিবেকানন্দ বলছেন ” যদি কায়মনোবাক্যে আমি কোন সৎকার্য করিয়া থাকি,যদি আমার মুখ হইতে এমন কোনো কথা বাহির হইয়া থাকে,যাহা দ্বারা জগতে কোন ব্যক্তি কিছুমাত্র উপকৃত হইয়াছে,তাহাতে আমার কোন গৌরব নাই,তাহা তাঁহারই। কিন্তু যদি আমার জিহ্বা কখনও অভিশাপ বর্ষণ করিয়া থাকে,যদি আমার মুখ হইতে কখনও কাহারও প্রতি ঘৃণাসূচক বাক্য বাহির হইয়া থাকে,তবে তা আমার,তাঁহার নয়।যাহা দুর্বল, যাহা কিছু দোষযুক্ত, সবই আমার।যাহা কিছু জীবনপ্রদ,যাহা কিছু বলপ্রদ,যাহা কিছু পবিত্র, সকলই তাঁহার প্রেরণা,তাঁহারই বাণী এবং তিনি স্বয়ং।সত্যই বন্ধুগণ,জগৎ এখনও সেই মহামানবকে জানিতে পারে নাই।”
এই অনুভবও একজন আলোকপুরুষের প্রতি অন্তরের বিস্ময়।
আর গ্রন্থটির প্রভাব কেমন ছিল? স্বামী বিজ্ঞানন্দজী একবার শ্রীমকে বলেছিলেন,অনুসন্ধানের পর আমি এই সিদ্ধান্ত করেছি, যারা শতকরা আশিজন বা তারও বেশি সন্ন্যাসী কথামৃত পাঠ করে এবং আপনার সান্নিধ্যে এসে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেছেন।”
আমরা সৌভাগ্যবান সেই অমৃতগ্রন্থের পাঠ শুধু সন্ন্যাসী নয়,সংসারিও করতে পারে।শেষ করব সেই আত্মলীন কবি জীবনানন্দের প্রেম কবিতার চরণ তুলে—–
“সকল ক্ষুধার আগে তোমার ক্ষুধায় ভরে মন!
সকল শক্তির আগে প্রেম তুমি, তোমার আসন
সকল স্থলের পরে,সকল জলের পরে আছে
যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছে
হে প্রেম তোমার!যেইখানে শব্দ নাই, তুমি আলোড়ন তুলিয়াছ!
অঙ্কুরের মতো তুমি,যাহা ঝরিয়াছে আবার ফুরায় তারে!তুমি ঢেউ,হাওয়ার মতন!
আগুনের মতো তুমি আসিয়াছ অন্তরের কাছে”

সেই অন্তর থেকে একটি মাত্র শব্দ প্রণাম।
—————-//———————
১৫ এপ্রিল, ২০২০.বুধবার।
©শুভঙ্কর দাস।হলদিয়া।