প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী— এক আশ্চর্য মহাজীবন কথা (পর্ব-৫) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
380

……..ব্রাহ্মসমাজ যে একেবারে নাস্তিক, তা তো নয়। তাঁরা নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক, ব্রাহ্ম তাই । তাঁদের মূল মন্ত্র হল—ওম্ ব্রহ্ম কৃপাহি কেবলম্।

উনিশ শতকে হিন্দুধর্ম যখন জাতপাত, কৌলিন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদি নানা কুসংস্কার ও আচারে কবলিত, ওষ্ঠাগত—–তখন পরলোকহিতৈষী, মানবতাবাদি , আধুনিক যুক্তিনিষ্ঠ মনের মানব মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করে ধর্মের সার নির্য্যাস আহরণ করার চেষ্টা করলেন। তিনি দেখলেন সব ধর্মের মূল কথা বা উদ্দেশ্য-আদর্শ কিন্তু একই—–মানবত্বের জাগরণ করা। অর্থাৎ, মানুষকে নৈতিক বিবেকবোধের চেতনায় উন্নীত করা , প্রকৃত মানুষ হতে শিক্ষা দেওয়া । আর তাই তিনি উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আধুনিকভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা শুরু করলেন। কোন প্রকার ধর্মীয় বিভেদ না রেখে যে কোন ধর্মের মানুষ এই বিশ্বাস নিয়ে এক ছাতার তলায় আসবে যে আমরা সকলেই এক ব্রহ্মের সন্তান।হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ঈঁসাই ভেদ তো আমাদের বানানো। এই ভেদদৃষ্টি না রেখে, আমরা সকলে এক পরম পিতার সন্তান হয়ে একসঙ্গে উপাসনা-প্রার্থনা করবো তাঁর। এ ধর্মে কোনো পূজা-উপাচারের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু পবিত্র মনে একনিষ্ঠ প্রার্থনা ও তাঁর অস্তিত্ব অনুভবের চেষ্টা ধ্যানের মধ্য দিয়ে। আর যাঁরা এই আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে নিজেদের চিরাচরিত ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে এগিয়ে আসবেন তাঁরা একত্রে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হবেন। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ২০শে আগস্ট তাঁর নিজের মতের অনুগামী বন্ধুদের নিয়ে গঠন করলেন এই ব্রাহ্মসমাজের রাজা রামমোহন রায়।

তবে শুরুটা যেমনভাবে হয়েছিল ব্রাহ্মসমাজের তা যেমন প্রাথমিক ভাবে পড়ে বা জেনে মনে হবে অত্যন্ত বাস্তববাদী ও আধুনিক মনস্ক চিন্তাধারা এঁদের যা প্রশংসা বা সাধুবাদ দাবি করে,পরবর্তীতে নানান মত-অমতের চাপান-উতোরে ব্যাহত হয় এই ধর্মের গতি । বহুমুখী হয় মতধারা। যার দরুন ক্রমশ ফিকে হয় ব্রাহ্মসমাজের জনবল। বিজয়কৃষ্ণের জীবনী পর্যালোচনা করতে করতে আমরা জানবো সেসব আকর্ষণীয় ইতিহাস কথা।

১২৬৭-৬৯ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ, ১৮৬০-৬২ খ্রিষ্টাব্দের কথা বলছি। জোড়াসাঁকোতে ব্রাহ্ম সমাজের সভায় যোগদান করে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তৃতা শ্রবণ করে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। মহর্ষির সভায় এরপর বেশ কয়েকবার ঘনঘন যেতে থাকলেন তিনি কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে। শরতের মেঘমুক্ত আকাশ যেমন ঝলমল করে রৌদ্রৈ, সকল সন্দেহ-সংশয়- সংকোচের দোলাচল দূরে গিয়ে বিজয়কৃষ্ণের মন যেন খোলা আকাশের মধ্যে মুক্তবিহঙ্গ হয়ে উড়ে যেতে থাকলো এখন। তাঁর মনে হলো এমন একটি ধর্মীয় বাধাহীন বিরাট প্রেক্ষাপটই তো তিনি চেয়েছিলেন তাঁর অন্তরের পুরুষটিকে অনুভব করার জন্য। আর তাই যদিও তিনি তাঁর মাতৃদেবীর কাছে বৈষ্ণবধর্ম দীক্ষিত ছিলেন পূর্বেই, কিন্তু তবু আজ ব্রাহ্মধর্মের প্রতি নিজের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসকে শিলমোহর দিতে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে দীক্ষা নিলেন। ইতিপূর্বে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে যোগদান করেছেন এই ধর্মে। এখন থেকে ব্রাহ্মধর্মের একনিষ্ঠ কর্মী ও প্রচারক হলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অনুগত, বাধ্য , মহর্ষিতে বিমুগ্ধ এই শিষ্য ।

কিন্তু, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তো আর পাঁচজনের মতো সাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী নন। সিংহগ্রীব, সিংহবীর্য, সিংহপ্রতীম পুরুষ তিনি। তাঁর বিবেকবোধ ও চরিত্রের দৃঢ়তা অনমনীয় ছিল। কায়মনোবাক্যে সব কিছু মত মেনে নেবার পাত্র ছিলেন না তিনি। নিজের বিবেক বুদ্ধি তাঁকে যখন যে অনুভূতি প্রদান করেছে , তিনি সেই ভাবেই পদচারণা করেছেন । ছকে বাঁধা পথে হাঁটা তাঁর স্বভাব নয় । তাই তো তাঁর জীবনে এত বৈপরীত্য, এত টানাপোড়েন, এত পথ পরিবর্তন চোখে পড়ে। কেন একথা বললাম, তা পাঠকগণ আপনারা বুঝতে পারবেন অচিরেই।

বাল্যসখা অঘোরনাথ গুপ্ত ও গুরুচরণ মহলানবীশের সাথে বিজয়কৃষ্ণ একসঙ্গে দীক্ষা নিয়েছেন দেবেন্দ্রনাথের কাছে। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হবার পরই তাঁর মনে হতে থাকলো, যদি জাতপাতের বিভেদ নাই মানবো, তবে বৃথা এই উপবীত ধারণ করে থাকবো কেন? এই উপবীত দ্বারা আমি তো এ পরিচয়ই জানাচ্ছি যে আমি ব্রাহ্মণ । কিন্তু আমি তো এখন ব্রাহ্মণ-চন্ডাল , কুলীন-শূদ্র এসবের অনেক ঊর্ধ্বে। তবে কী এসবের আর প্রয়োজন আছে? বিজয়কৃষ্ণ তাই একদিন সরাসরি প্রশ্নই করে ফেললেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে । বললেন, “মহর্ষি, আপনার মনে হয় কি ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী হবার পরও ব্রাহ্মণ ধর্মের চিহ্নস্বরূপ এই উপবীত ধারণ করার কোন প্রয়োজন আছে? মহর্ষি বললেন, “হ্যাঁ আছে বৈকি! পৈতে না ধারণ করলে সমাজের ক্ষতি হয়। আমিও তো করি। এই দ্যাখো।” এই বলে তিনি নিজের উপবীতখানি হাতে তুলে দেখালেন। আশ্চর্য হলেন বিজয়কৃষ্ণ। তিনি আরও একটি প্রশ্ন করলেন,বললেন, “আমিষাহার কি করা উচিত?” মহর্ষি মত প্রকাশ করলেন,”করা উচিত। কারণ মাছ না খেলে দেহ রক্ষা করা যায় না।” বিজয়কৃষ্ণ শুনলেন দুটি উত্তরই , কিন্তু, গুরুবাক্য জ্ঞান করে বুদ্ধিতে-চিত্তে ধারণ করতে পারলেন না। তবে যেহেতু মহর্ষিকে ভক্তি করেন তাই বাদ-প্রতিবাদও কিছু করলেন না।

যেটা বলা হয়নি তা হল এখন কিন্তু বিজয়কৃষ্ণ মেডিকেল কলেজের ছাত্র । কেন একজন সংস্কৃত কলেজের ছাত্র হঠাৎ মেডিকেল কলেজে পড়তে এলেন —-তার উত্তরও কিন্তু সেই প্রথাভাঙ্গার প্রচেষ্টা। আসছি সে প্রসঙ্গে।

——–ক্রমশঃ
——ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।