প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী— এক আশ্চর্য মহাজীবন কথা (পর্ব-৬) : রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।

0
455

প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী গুরুগিরি করবেন না স্থির করলেন । কারণ , তাঁর মনে হয়েছে এই পথে অর্জিত প্রণামী বা ধন থেকে জীবিকা নির্বাহ যেন এক প্রকার শিষ্যব্যবসা। আর, শিষ্যব্যবসা তিনি করবেন না। তাই , অনেক ভেবেচিন্তে তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন শেষ করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেসময় গুরুগিরি করেই শান্তিপুরের গোস্বামীদের সংসার প্রতিপালন হত। এখন যখন মাতা স্বর্ণময়ীদেবীর কাছে নিজের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করলেন, মাতা ভীষণ দুঃখিতা হলেন পুত্রের এমন পথে হাঁটার সিদ্ধান্তে। কিন্তু রাজি না হয়ে উপায় নেই। পুত্র যে লক্ষ্যে স্থির থাকে নিজের। যেটা ভাল মনে হবে তাই করবে। অগত্যা অনুমতি দিতে হল মেডিক্যাল কলেজে পড়ার। মেধাবী বিজয়কৃষ্ণ ভর্তি হয়ে গেলেন ডাক্তারিতে ১২৬৭ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে । অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, প্রখর মেধার অধিকারী তিনি। যখন যা একবার ক্লাসে শুনে নিতেন আর ভুলতেন না তা।কখনও অধ্যাপকদের লেকচার নোট করতেন না খাতায়। অধ্যাপকসহ ছাত্ররা পর্যন্ত সকলে আশ্চর্য্য হতেন তাঁর স্মৃতি ও বুদ্ধির প্রাখর্য্যে। এখানেও তিনি সেরা ছাত্র ছিলেন ক্লাসে। তাঁর সুব্যবহার, উন্নত চরিত্রের জন্য অচিরেই কলেজের নেতা হয়ে সকলকে পরিচালিত করতে থাকলেন তিনি। এরকিছুদিন পরই ব্রাহ্মধর্মে যোগ দেন।

কলেজে ক্লাস শুরু হতে বেশ কিছুদিন দেরী তখন। তাই শান্তিপুরে রয়েছেন বিজয়কৃষ্ণ। একদিন তিনি আলোচনা করছেন এই বলে যে মনুষ্য মাত্র ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বর তো ব্রাহ্মণ-শূদ্র ভেদব্যবস্থা করেননি। করেছি আমরা মানুষরাই। তাঁর কাছে তো সব মানুষই সন্তান তুল্য। আমাদের উচিত তাই মানুষে-মানুষের বিভেদ না করা।—– এসব সাম্যবাদীতার জ্ঞানোপদেশ যখন করছেন এমন সময় সেখানে উপস্থিত একটি বালক হঠাৎ বলে বসে, “যখন আপনার ভেদদৃষ্টি নেই তখন এই পৈতে রেখেছেন কেন? পৈতে দ্বারা তো ব্রাহ্মণকে বোঝানো হয় । এখানেই তো ভেদ করে দিলেন নিজেকে আপনি। তাই না! ”

বালকের কথা সেই মুহূর্তেই বিজয়কৃষ্ণের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করলো। তাঁর এ নিয়ে সংশয় তো আগে থেকেই ছিল, এখন যেন সে সংশয়ে সিদ্ধান্ত স্থাপিত হল। তিনি বললেন, ‌ “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ । এই উপবীত জাতিভেদকে চিহ্নিত করে । আমি আর রাখবো না একে। এই মুহূর্তে পরিত্যাগ করবো।” এই বলে নিজেই নিজের পৈতেটি খুলে ফেললেন। এমন একখানা কান্ড যে হতে পারে বালকটি বোঝেনি। সে বালকসুলভ বুদ্ধিতেই ছুটে গেল স্বর্ণময়ীদেবীর কাছে। উৎকণ্ঠিত, ভয়ার্ত কন্ঠে সব জানালো— “শিগগির চলো, তোমার ছেলে পৈতা খুলে ফেলে দিয়েছে , দেখবে চলো।” স্বর্ণময়ী ছুটে এলেন। এসে দেখে কেঁদে আকুল হলেন। পুত্রকে অনেক বোঝানোতেও কাজ হল না দেখে পরিশেষে আত্মহত্যা করবেন বলে মনস্থির করলেন। ছুটলেন তা করতে। অগত্যা পরিস্থিতির ভার বুঝতে পেরে আবার পৈতেটি পড়ে নিতে বাধ্য হলেন বিজয়কৃষ্ণ। মাতার মন শান্ত হল। কিন্তু সে পৈতে তাঁর পুত্র বেশী কাল বহন করতে পারল না । তিন বছরের মাথায় আবার উপবীত পরিত্যাগ করলেন বিজয়কৃষ্ণ।

মেডিক্যাল কলেজের শেষ তিন বছরের ফাইনাল পরীক্ষার আগে ওষুধ চুরির মিথ্যা অভিযোগ করে বাংলা বিভাগের এক ছাত্রকে সাসপেন্ড করে হাজতে পুরে দিলেন অধ্যাপক চিবার্স সাহেব। বিজয়কৃষ্ণের নেতৃত্বে কলেজের ছাত্ররা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। বিদ্রোহ জানিয়ে কলেজ বয়কট করলেন তাঁরা। পরিশেষে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হস্তক্ষেপে সমস্যার সমাধান হল। বিদ্যাসাগরের কথায় ছোটলাট বিডন সাহেব আদেশ দিলেন অবিলম্বে সকলকে কলেজে ফেরত নিতে হবে। আর যে সকল দুঃস্থ ছাত্রের কলেজ ছাড়ার কারণে বৃত্তি পাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁদের অর্থের যোগান বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজেই করে দিলেন।

এরপরই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী কলেজের ছাত্রদের নিয়ে ‘হিতসঞ্চারিণী’ নামে একটি সভা স্থাপন করলেন। সেই সভাতেই একদিন তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে, “আমরা যা সত্য, যা উচিৎ বলে জানবো তাই গ্রহণ করবো। কোন কুসংস্কার বা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে পথ চলবো না।” বিজয়কৃষ্ণ উপবীত ত্যাগ করে ফেললেন। কারণ সেই এক—জাতিভেদের প্রতীক পৈতে। অতএব, পৈতে রাখা মানে জাতিভেদকে প্রশ্রয় দেওয়া। নিজের বংশকৌলিন্যকে প্রমাণ করা।

কিছুকাল পর যখন পৈতেহীন অবস্থায় শান্তিপুরে নিজের গৃহে ফিরলেন, তখন সেখানে তাঁর এমন হঠকারীতার জন্য উঠল তুমুল এক ঝঞ্ঝাবাত । সকলে তাঁকে ধিক্কার দিতে থাকলেন, গালাগালও করতে থাকলেন। মাতা পুত্রের চরণে পড়ে অনুরোধ করতে থাকলেন উপবীত গ্রহণ করার জন্য । মাতাকে নিজের পদ জড়িয়ে থাকতে দেখে বিজয়কৃষ্ণ মূর্ছা গেলেন। পরে সংজ্ঞা ফিরলে তিনি মাতৃদেবীকে বোঝালেন যে , পৈতে তিনি গ্রহণ করবেন মাতার কথায়, কিন্তু, পৈতে ধারণের পর প্রাণ আর রাখতে পারবেন না। অগত্যা স্নেহময়ী জননী বললেন, “বেশ বাছা, তুমি উপবীত ছাড়াই থাকো। শুধু প্রাণে বেঁচে থাকো তাহলেই হবে ।” মায়ের মন তো একেই বলে!

শান্তিপুরের সমাজ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলেন না উপবীতহীন বিজয়কৃষ্ণকে। তাঁরা একযোগে এই নির্দেশ জারি করলেন যে, শান্তিপুর ছেড়ে অবিলম্বে তাঁকে চলে যেতে হবে। না হলে সেখানকার অন্যান্য যুবকেরা বিপথগামী হবে। বিজয়কৃষ্ণ সদর্পে জানালেন যে তিনি বেশ কিছুদিন সেখানে থাকবেন ও শ্রীশ্যামসুন্দরের মন্দিরকে ব্রাহ্মমন্দিরে পরিণত করবেন। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার করবেন সেখান থেকে। এমন কথা শুনে আগুনে ঘি পড়ল। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে বহিষ্কার করা হল, সমাজচ্যুত করা হল। সকলেই তাঁকে পরিত্যাগ করলেন। কেবল ভগিনীপতি কিশোরীলাল মৈত্র তাঁকে মেনে নিলেন। তিনিও ব্রাহ্ম হয়ে বিজয়কৃষ্ণের শাশুড়ি মাতা ও গৃহিণীর সঙ্গে একসঙ্গে কলকাতায় চলে এসে থাকতে লাগলেন।

বিজয়কৃষ্ণের ব্রাহ্মধর্মের শ্রীগুরুদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উপবীত ত্যাগের আদর্শে যে অবিশ্বাসী ছিলেন—তা আমরা আগেই জেনেছি। তিনি নিজেই উপবীত ধারণ করতেন। আর, তা তিনি নিজেই বিজয়কৃষ্ণকে দেখিয়েছিলেন। অথচ, উপবীত জাতিভেদের চিহ্ন বলে মহর্ষির আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে সেটি ত্যাগ করে ফেলেছিলেন বিজয়কৃষ্ণ। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর থেকে বিজয়কৃষ্ণ দীক্ষা নেন এবং ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে যখন দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে এই নিয়ম চালু করলেন যে উপবীতধারী আচার্য দ্বারা ব্রাহ্মসমাজে উপাসনা চলবে তখন তাঁকে একারণে ত্যাগ করলেন বিজয়কৃষ্ণ । অর্থাৎ, গুরুত্যাগী হলেন। এমনই তেজোঃদীপ্ত ছিল বিজয়কৃষ্ণের বিবেকবোধ । তিনি নিজের আদর্শের সঙ্গে কখনো আপোষ করেননি। নিজের চিন্তাধারা মতপ্রবাহকে মর্যাদা দিতে তাই বারেবারে নিজের জীবনের নিয়মভাঙ্গা পথে তাঁকে হাঁটতে দেখা গেছে। একারণেই তাঁর জীবন ইতিহাসে এত ভাঙ্গা-গড়া , এত চড়াই-উতরাই , এত বাদ-প্রতিবাদ, এত বৈপরীত্য ! বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর স্বাতন্ত্রতাই তাঁকে সারাটি জীবন ধরে সকলের থেকে পৃথক করেছে । তিনি সকল নক্ষত্রের মধ্যে হয়েছেন লুব্ধকসম নজরে পড়ার মতো।

——–ক্রমশঃ
——ভক্তকৃপাপ্রার্থিনী
রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক।