তিতিবিরক্ত : দিলীপ রায়।

0
441

“হনহন করে কোথায় ছুটলে বসাকগিন্নি ?”  রাস্তায় দেখা ত্রিপাঠীগিন্নির সাথে । ত্রিপাঠীগিন্নি আর বসাকগিন্নি, উভয়েই গাঁয়ের গিন্নি হিসেবে প্রায় সমসাময়িক । কিন্তু  ত্রিপাঠীগিন্নির কথাবার্তায় মিষ্টতা নেই বললেই চলে  ।  কেমন যেনো কর্কশ স্বভাব !  চেহারাটাও তেমনি রুক্ষ ।

যাই হোক কলাবতী বসাক নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে পাচ্ছেন না । সেখান থেকে ঘটনার সূত্রপাত ! কলাবতী বসাকের আবার মণিকার ঘ্যানঘ্যানানী ভীষণ  অপছন্দ । মণিকা কলাবতীর একমাত্র ছেলের বৌ ।  একটা কথা বারংবার বলা সত্ত্বেও কলাবতীর সেই পুরানো  কথার পুনরাবৃত্তি, “বিয়ের পাঁচ বছর অতিক্রান্ত । অথচ বৌমার পেটে ছেলেপুলের খবর নেই ।“  একই  ঘ্যানঘ্যানানী  সনাতনকেও শুনতে হচ্ছে । সনাতন মাকে বুঝিয়েছে, “ভগবান যখন চাইবে তখন তুমি নাতি-নাতনীর মুখ অবশ্যই দেখতে পাবে ।“ তাতেও কলাবতীর শান্তি নেই । তিনি বাস্তবকে বিশ্বাস করেন । তাই কলাবতী রেজাল্ট দেখতে চান ! ছেলের মিষ্টি কথায় তিনি সন্তুষ্ট নন ।

অবসর মুহূর্তে কলাবতী ভাবছেন, সনাতন বিয়ে করেছে নিজের ইচ্ছায় । সেই সময় কলাবতী তাঁর ছেলেকে পইপই করে বলেছিলেন, “বেজাতের মেয়েকে ঘরে তুলিস না । তাঁরা সংসারে এসে গোছানো সংসার তছনছ করে দেবে ।“  কে শোনে কার কথা, জোর করে ধোপার মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুললো । এখন পস্তাও । ছেলেপুলে হচ্ছে না ।  গাঁয়ের মানুষে উল্টোসিধে কথা শোনাচ্ছেন, “বৌটা নাকি বাঁজা  । যাকে বলে নিস্ফলা । তার সন্তান ধারনের ক্ষমতা নেই ।“

গাঁয়ের মানুষের ঐসব কথা শুনে কলাবতী ভড়কে গেলেন । সত্যিই তো, মণিকার পোয়াতী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ । তাই একদিন কলাবতী  সনাতনকে ডেকে বললেন, “আমি তোকে আবার অন্যত্র বিয়ে দেবো । ঘরে নাতি না এলে বংশ সামলাবে কে ? আমার বংশ রক্ষার মানিক দরকার ?“  কলাবতীর এইসব উটকো আবদারে বাড়িতে হুলস্থুল । কথা শুনে  মণিকা ক্ষেপে লাল ! বৌমার কী গোঁসা ! শুরু হল বৌমার নাকি-কান্না ! কান্নার ঢঙ দেখলে কলাবতীর শরীর জ্বলে যাওয়ার উপক্রম ।  সনাতন মাকে ধমক দিয়ে বলল, “তুমি মণিকার সম্বন্ধে  অবাঞ্ছিত কথা  বন্ধ করো । মা তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি,  আমাকে দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা পুনরায় বলবে না । ছি ছি, তুমি শেষে কিনা আমাকে সমাজের কাছে মাথা হেট্‌  করতে চাইছ ?”

 

( ২ )

ছেলে বৌয়ের তুলকালামে কলাবতি বিষণ্ণ । ছেলে ও বৌয়ের যৌথ লাঞ্ছনায় কলাবতী  রাগে ক্রোধে হৃদয়ান্তরে অনুশোচনায় জ্বলছেন । বারংবার বলা সত্ত্বেও তখন  বেজাতের মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে কলাবতীর এখন দুঃখ বারোমাস । পরের বাড়ির মেয়ের  সাথে তাল মেলাচ্ছে তাঁর পেটে ধরা ছেলে । ছেলের এহেন আচরণে কলাবতীর মনে ভীষণ কষ্ট  ।  বৌয়ের  কাছে ভাল থাকার জন্যে ছেলে কিনা নিজের মাকেই  ধমক ! ছেলের ধমক খেয়ে কলাবতী মনোকষ্টে ভুগছেন, আর মনে মনে ভাবছেন, “তাঁর পেটে ধরা ছেলের কাছে ধমক খাওয়ার আগে কেন তাঁর মৃত্যু হল না ?”  তিনি আরও ভাবছেন, “বাকী জীবন কারো গলগ্রহ হয়ে থাকতে রাজি  নন । ছেলে বৌমার গলায় অবাঞ্ছিত বোঝা হয়ে কলাবতী আর বাঁচতে নারাজ ।“  এই জন্য রাগে দুঃখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁর ছোট মেয়ের বাড়ি ছুটলেন । ছোট মেয়ের  বিয়ে হয়েছে বলাগড়ে । বলাগড়ে  যাওয়ার জন্য তিনি হনহন করে  হাঁটছিলেন ।  রাস্তায় ত্রিপাঠী গিন্নি অর্থাৎ যমুনার সঙ্গে দেখা । গ্রামে তাঁরা একে অপরে একসঙ্গে  দীর্ঘদিনের চলার সাথী । তাই সেই মুহূর্তে  যমুনাকে  ছাড়বার পাত্রী কলাবতী নন ।  যমুনার পথ আগলে বললেন, “উহু  দিদি ! দু-দণ্ড আমার সাথে কথা না বলে আপনি এগোতে পারবেন না ।“ অগত্যা দুজনে গাঁয়ের মনসা কর্মকারের রাস্তার উপরে কাঠাল গাছ তলায় গিয়ে বসলেন । কৌটা থেকে তৈরী করে রাখা দুটো পান বার করে একটা পান হাত বাড়িয়ে যমুনাকে দিলেন এবং অন্যটা কলাবতী  নিজে খেলেন  ।

পান চিবোতে চিবোতে যমুনার উদ্দেশে কলাবতী বললেন, “ঢঙ করে আমার পথ আটকালি কেন ?”

হনহন করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি ?

আমি ছোট মেয়ের বাড়ি যাচ্ছি  ।

এই  পড়ন্ত বেলায় ছোট মেয়ের বাড়ি কেন ? যদিও বা গেলে,  কিন্তু দিনের আলোতে পৌঁছাতে পারবে ?

পারবো । তবে একটু রাত হবে ।

এবার তোমার খবর বলো ত্রিপাঠীগিন্নি ? মনে হচ্ছে সংসারে তোমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো অশান্তি  !

অশান্তি সাংঘাতিক । অশান্তির বারোমাস্যা বলে শেষ করা যাবে না ।

“তবে এবারের অশান্তির কারণ কী ?” জানার জন্য উদ্গ্রীব বসাকগিন্নি ।

ছেলেটা বলে কিনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও ! মাকে বলার ধরনও আলাদা । চোখ রাঙিয়ে তেজি গলায় মাকে অপদস্থ ! তাও আবার বৌয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে মায়ের উপর হম্বিতম্বি ! এসব কথা  ভাবাটাও কষ্ট । তুমি আমার কাছের মানুষ,  প্রাণের মানুষ । দীর্ঘদিন এই গ্রামে সুখে দুঃখে পাশাপাশি রয়েছি । তাই তোমাকে সব কথা বলতে আমার বাধা নেই । আপন মানুষই আমার মনের গভীরের দুঃখের কথা বুঝবে !

“তোমার ছেলের বৌ শুনেছি গুণবতী । লেখাপড়াও কিছু শিখেছে । তার পেটে বিদ্যে রয়েছে । তাহলে তোমার টেনশন কীসের ?” বললেন বসাকগিন্নি ।

( ৩ )

যমুনা তাঁর ছেলে ও বৌয়ের হাতে রীতিমতো নাস্তানুবাদ ।  বসাকগিন্নিকে কাছে পেয়ে তাঁর মনের ক্ষোভ  উগরে দিলেন ।

আমার বেটার তিন মেয়ে । ছেলে নেই । আমাদের গাঁয়ে মেয়ে পড়ানো নিষিদ্ধ । গ্রামের সমাজের রীতি নীতি তুমি তো ভাল জানো ।  গাঁয়ের  মুখোর্জে পণ্ডিত বিধান দিয়েছেন মেয়ে পড়ানো নিষিদ্ধ ।  শাস্ত্রবিরোধী কাজ ।  মুখোর্জে পণ্ডিতের কত জ্ঞান ! তাঁর অনেক লেখাপড়া । শাস্ত্রীয় তর্কে তিনি ভীষণ দক্ষ ।  গাঁয়ের মোড়ল মাতবরেরা তাঁকে মান্যতা  দিয়ে তাঁর বিধান গ্রামে চালু রেখেছেন । আজ  পর্যন্ত সেই বিধান কারও লঙ্ঘন করার সাহস হয়নি । হাতে গোনা কয়েকজন যাঁরা অতি উৎসাহিত হয়ে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন,  তাঁরা এখন সমাজে ‘এক ঘরে’ হয়ে রয়েছেন ।

“হিন্দু ধর্মের মানুষ হয়ে মেয়েকে কীভাবে স্কুলে পাঠাবি  ?”  ছেলেকে এই কথা বলাতেই বৌ কোথা থেকে ছুটে এসে আমার উপরে  কী চোটপাট !  ছেলের বৌয়ের  কী রাগ ! আমাকে বলে কিনা, “আপনি কিচ্ছু জানেন না ।“  আমি চার মেয়েকে বিয়ে দিলাম । একমাত্র ছেলেকে মানুষ করলাম । অথচ পরের বাড়ির মেয়ে চটজলদি সাতপাঁচ না ভেবে আমার সম্বন্ধে বলে কিনা,  “আমি কিচ্ছু জানি না ।“  ছেলেকে অক্ষরজ্ঞান শিখিয়েছিলাম বলেই সে বি-ডি-ও অফিসে যাই হোক ছোটখাটো  চাকরি করতে পারছে । ছেলেটা পেটে ধরেছিলাম বলেই বাড়িতে বৌমার  আগমন । অথচ সেই বৌমার শাশুড়িকে অপমান ! ভাবতেই চোখে জল আসে ।

কর্তা  মাঠে অনেক চাষের জমি রেখে গিয়েছেন । চাকরি আর মাঠের জমির ফসল নিয়ে দিব্যি ভালই  সংসার চালাচ্ছে  আমার ছেলেটা । মেয়েদেরও ভাল জায়গায় বিয়ে দিয়েছি, যার জন্য  তারা আজ নিজ নিজ সংসারে প্রতিষ্ঠিত । ছেলেকে তাদের ভরণ-পোষণ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না । গাঁয়ে অনেকের বাড়ির মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পরেও তাদের সংসার টানতে হচ্ছে । ছেলে ও বৌমার এত সুখ আর কোথায় পাবে ? তাই তাদের লঘু গুরু জ্ঞান নেই । শাশুড়ির সাথে কীভাবে ব্যবহার  করতে হয় বৌমার সেটাই অজানা । তাই জমিগুলি নিয়ে ভাবছি, কী করা যায় !

তিনি কথা প্রসঙ্গে গাঁয়ের মেয়েদের পরিস্থিতি নিয়ে আরও বললেন, যেসব মেয়েরা স্কুলে পড়ছে সেই মেয়েগুলির  হাইস্কুল  পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে । গাঁয়ের সুবল কংসবনিকের মেয়েটা শুনলাম আট ক্লাস পার হওয়ার পর এক দোজ বরের সঙ্গে সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে ।  অথচ বাড়ির   বৌমাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না, “মেয়ে পড়িয়ে কোনো লাভ নেই । বরং পুরোটাই  লোকসান !”  ছেলেটাও তেমনি, বৌ যা চাইছে তাতেই তার সম্মতি । বুড়ো মা কী তোর কাছে ফেলনা ! এই নিয়ে বাড়িতে তুমুল  হইচই । যমুনার আবার ‘মান-সম্মানের’ জায়গাটা ভীষণ জাগ্রত । তাই শাশুড়ির বিরুদ্ধে বৌমার লাগা, তাঁর অপছন্দ । সেই জন্য তিনি বৌমাকে বলে দিয়েছেন, “মাঠের সব জমি তাঁদের কর্তা ও গিন্নির উভয়ের নামে ছিল । কর্তা চলে যাওয়ার পর  সমস্ত জমির মালিক তিনি নিজে ।  তাই  তিনি চাইছেন,  মাঠের সমস্ত জমি মেয়েদের নামে লিখে দিতে ।“  সেই কারণে জমি রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখকের বাড়ি যাচ্ছিলেন  । আমার সাথে লাগতে আসা, তার ফল ছেলে ও বৌমাকে ভোগ করতেই হবে । আমিও দেখতে চাই, মা বেঁচে থাকতে ছেলের বৌ কীভাবে গৃহকর্তী হয়  !

( ৪ )

কলাবতী ও যমুনা,  দুজনেই বাড়ির ছেলে-বৌমার উপর তিতিবিরক্ত । দুজনেরই আপশোশ, ছেলেরা নিজের নিজের বৌয়ের কথা শুনে তাঁদের মায়েদের  যোগ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করছে !

অন্যদিকে উভয়েরই ছেলে-বৌমা নিজ নিজ সিদ্ধান্তে অটল ।

যমুনা কলাবতীকে একটা প্রস্তাব দিলেন, “যেহেতু দুজনেরই বাড়ি থেকে বের হওয়ার ইসু এক,  সুতবাং আমরা এমন একটা  কাজ করি যাতে উভয়ের ছেলে-বৌমা তাঁদের উদ্ধারে হন্যে হয়ে খুঁজতে বের হয় ।“

কলাবতী বললেন, কাজটা কী আগে শুনি ?

“দুজনে একসঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে উঠি” যমুনা খুব গর্বের সঙ্গে কলাবতীকে বললেন ।

প্রস্তাবটা মন্দ নয় ! কিন্তু আমি বৃদ্ধাশ্রম চিনি না । তা ছাড়া কখনই আমি বৃদ্ধাশ্রমে যাইনি ।

“আমি তো রয়েছি, আমি নিয়ে যাচ্ছি । তবে যেতে সময় লাগবে ।“ যমুনা কলাবতীকে  আশ্বস্ত করলেন ।

দুজনে উঠে রওনা দিলেন । তারপর ………।

স্বাগতম,  “কণকলতা ওল্ড এজ হোম” ।

————–০—————-