রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ও আমরা বাঙালী : প্রশান্ত কুমার দাস।

0
1247

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী –দিনটিকে আমরা বাঙালীরা ভুলতে পারিনা। বাঙালির কাছে এ এক স্মরণীয় দিন । ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই দিন বাংলাদেশে ‘শহীদ দিবস’ রূপে পালিত হয় আর ২০০০ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী “আর্ন্তজাতিক মাতৃদিবস” হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
আমাদের মাতৃভাষা- বাংলাভাষা-যে ভাষায় নিতাই- গোরা সারা দেশে ভক্তিস্তোত্র বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন- যে ভাষাতে রবীন্দ্রনাথ,বঙ্কিমচন্দ্র,মধুসূদন,শরৎচন্দ্র বিশ্বসাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন – এই ভাষাতেই বিদ্রোহি কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রক্ত-ঝরা কবিতা লিখে ব্রিটিশ শক্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন – এই ভাষাতেই ‘হরিবোল’ গাইতে গাইতে আমরা ভবসাগর পার হয়ে যায়।
এই ভাষাতেই আমরা বাঙালীরা বড় হয়েছি, কথা বলেছি, গান গেয়েছি এবং আজও বেঁচে আছি।
কিন্তু এই মাতৃভাষা দিবসটা সিক্ত হয়ে রয়েছে অনেক সন্তানহারা-মায়ের অশ্রুজলে- তাই ভুলতে পারছিনা ছেলে- হারা-মায়ের অশ্রুতে গড়া একুশে ফেব্রুয়ারীর কথা। কারন এই দিনটিতে বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর কয়েকশ বাঙালী ভাইয়ের রক্তে রঙিন হয়ে উঠেছিল- এদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনের নাম প্রকাশ্যে আসে-তারা হলেন আব্দুল সালাম, বরকত জব্বর,আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমেদ ও শফিউর।
সেই রক্তাক্ত দিনের স্মৃতি আজও মুছে যাইনি এবং শত শত বছর পরেও মুছে যাবেনা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো কিন্তু দ্বিখন্ডিত হয়ে – একটি ভারত যুক্তরাষ্ট্র অপরটি পাকিস্তান রাষ্ট্র ।তবে পাকিস্তান দ্বি-খন্ডিত রূপে- পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান । পাকিস্তানে যেমন উর্দূ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হলো তেমনি বাংলাদেশেও(পূর্ব পাকিস্তানে) ঊর্দুকে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো। তারা ঊর্দূভাষার ডাকটিকিট প্রকাশ করলো, ফর্মে ও খামে এবং সমস্ত ধরনের সাইনবোর্ডে ঊর্দূকে স্থান দিল।
কিন্তু বাংলার জনৈক মুসলিম ভাই মহঃ শহীদুল্লা উচ্চকণ্ঠে জানালেন –“আমরা যেমন মুসলমান সত্য, তেমনি আমারা বাঙালী”। অতএব বাংলাকেই আমাদের দেশে মর্যাদা দিতে হবে।“১৯৪৮ সালে আলিজিন্না জানালেন – পাকিস্তানে উর্দূই হবে রাষ্ট্রভাষা“। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনও জানিয়ে দিলেন- এদেশে উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
কিন্তু বাংলাদেশের বাংলাভাষীরা এই দাবীকে অগ্রাহ্য করলো এবং ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারে ঘোষিত ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে মিছিল নিয়ে এগিয়ে চললো বীর বিক্রমে।কিন্তু সরকার নৃশংসভাবে জনতার উপর গুলি চালালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে – যেখানে গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়লো কতশত তরুন তরতাজা যুবক। কয়েক শত হতাহত তরুণ প্রান-রক্তে লাল হয়ে উঠলো ঢাকার রাজপথ । বেশির ভাগ শহীদ হওয়া রক্তাক্ত দেহকে হাপিস করে দেওয়া হলো।
কিন্তু মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন থামলো না, বরং আরও তীব্রতর হলো পৃথিবীর ব্যাপী বিভিন্ন প্রান্তে । শেষকালে ১৯৯৮ সালে ২৯ শে মার্চ রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব কফি আন্নানের হাতে একটি আবেদন পত্র এসে পৌঁছালো।এই আবেদন পত্রে লেখা হয়েছিল – “পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা তিলে তিলে হারিয়ে যাচ্ছে।“ সেই আবেদন পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল বাংলাদেশের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের কথা এবং পাঁচ জন তরুনের শহীদ হওয়ার কথা। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে সকল রাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর তারিখ মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। তারপরে২০০০সালের ২১শে ফ্রেবুয়ারী প্রথম আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে পালিত হয়।
আজও আমরা প্রতিবছর এই দিনটিকে স্মরণ করে সেই মৃত্যুহীন প্রাণ শহীদের প্রতি আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই – কবিরা নতুন নতুন গান সৃষ্টি করেন, পত্রিকায়,ম্যাগাজিনে এই দিনের তাৎপর্য নিয়ে লেখা হয়, বিভিন্ন ক্লাব ও প্রতিষ্ঠান এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে।
দুই বাংলার বাঙালিরা ভাষার আকর্ষনে এক অভিনব মিলন সেতু তৈরী করে। কলকাতার বইমেলায় দেখা যায় বাংলাদেশের কবি ও সাহিত্যিকদের ,গড়ে ওঠে বাংলাভাষীদের মৈত্রী – হিন্দু মুসলিম পৃথক সত্ত্বা ভুলে যায় – বাঙালির ভাষার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে ঐক্যতান।
কিন্তু এত কিছুর পরেও একটা বেদনা মনের মধ্যে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। বর্তমান প্রজন্মের হাতে কি আর বাংলা ভাষার কদর থাকবে ? দেখা যাচ্ছে ,বাংলা ভাষা বাঙালিদের কাছে ক্রমশঃ ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে। সম্পন্ন ঘরের ছেলে মেয়েরা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে যাচ্ছে, বাবা-মা ছেলে মেয়েদের ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পাঠিয়ে গর্ববোধ করছেন। অনেকে বলেন – আমার ছেলে বেশ ভাল ইংরাজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু বাংলাটা ঠিক আসে না তাই পড়তে চায় না। আবার কেউ কেউ বাংলা ভাষা না জানাটাই গর্বের বস্তু বলে মনে করেন। শহরে এমনকি গ্রামেগঞ্জে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠছে। সেখানে অনেক অনেক বেশি খরচ করে অভিভাবকগণ ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করছেন শুধুমাত্র ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াবার জন্য।
আমি জানি ইংরাজি ভাষা একটা আর্ন্তজাতিক ভাষা এই ভাষাতে দক্ষতা অর্জন করা অতি অবশ্যই প্রয়োজন, এমনকি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিতেও আমদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কিন্তু বাংলাকে অবহেলা করা একদম উচিত নয়।
তাছাড়া আমাদের রাজ্যে এখনও ব্যাঙ্কে,পোষ্ট অফিসে বা সরকারী অফিসের সব ধরনের ফর্মগুলি ইংরাজি ভাষায় লিখিত। ইংরাজি নববর্ষে আমরা Happy New Year বলতে অভ্যস্ত । আমাদের কোনো অফিসে দরখাস্ত পাঠাতে হলে ইংরাজি ভাষায় লিখতে হবে। সুতরাং আমাদের বাংলার দৈন্যতার জন্য আমরাই দায়ী।
আজ আমরা যারা বাংলাকে ভালবাসি তাদের উচিত ২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলাদেশের শহীদদের প্রতি যেমন শ্রদ্ধা জানানো তেমনি আমাদের মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ বাংলাভাষাকে নতুন করে ভালোবাসা জানানো । আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতে বাংলা কবিতার বই ,গল্পের বই, ঠাকুরমার ঝুলি প্রভৃতি উপহার হিসাবে তুলে দেব।কারন বাংলা ভাষাই হচ্ছে বাঙালির আশা ভরসা। বাংলা ভাষা যদি অবলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আর বাঙালির অস্ত্বিত্ব থাকবে না।
এজন্য আজ সমস্ত বাঙালিকেই সজাগ থাকতে হবে, আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
আর একটা কথা আমাদের জানা প্রয়োজন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির শহীদ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে- তবুও এই দিনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সকল ভাষা ভাষীর মানুষ নিজ নিজ ভাষাকে ভালোবাসবে, নিজের নিজের ভাষার উন্নতির চেষ্টা করবে।সাঁওতালরা তাদের সাঁওতালী ভাষাকে প্রাধান্য দিবে, নেপালীরা তাদের নেপালী ভাষার জন্য গর্ববোধ করবে, উড়িয়ারা তাদের উড়িয়া ভাষাকে উন্নততর করার চেষ্টা করবে – এমনি করে প্রতিটি ভাষার মানুষ নিজের ভাষাকে মাতৃদুগ্ধ মনে করবে। তবেই ২১ শে ফেব্রুয়ারী দিনটি উদযাপন করা সার্থকমন্ডিত হয়ে উঠবে।