সুভাষ চন্দ্র দাশ,ক্যানিং —চড়ক পূজো হিন্দুসমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকউৎসব।নির্দিষ্ট ভাবে শাস্ত্রীয় নিয়ম রীতিনীতি মেনেই চৈত্র মাসের শেষ দিনেই এই পূজো অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপীও চড়ক পূজোর উৎসব চলে। লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে চৈত্র মাসে শিবের আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজোর উল্লেখ নেই। পূর্ণ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের বর্ষক্রিয়া কৌমুদী ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বেও এই পূজোর উল্লেখ পাওয়া যায় না।সমাজে উচ্চশ্রেণীর লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এই চড়ক পূজো উৎসব প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়।
চড়ক পূজো কবে কিভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস তথ্য আজও জানা যায়নি। তবে আনুমানিক ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই চড়ক পূজো প্রচলন করেছিলেন।রাজ পরিবারের লোকজন এই পূজো শুরু করলেও চড়ক পূজো কখনও রাজাদের পূজো ছিল না। এটি ছিল হিন্দু সমাজের লোকসংস্কৃতির একটি উৎসব। পূজোর সন্ন্যাসীরা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের কথিত নিচু সম্প্রদায়ের লোক। তাই এ পূজোয় এখনও কোন ব্রাহ্মনের প্রয়োজন পড়ে না,আবার কোন কোন স্থানে ব্রাহ্মন দ্বারা পুজো অনুষ্ঠিত হয় ।
এ পূজোর অপর আর এক নাম নীল পূজো। গম্ভীরা পূজো বা শিবের গাজন এই চড়ক পূজোরই অঙ্গ। চড়ক পূজো চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে পালিত হয়। আগের দিন চড়ক গাছটিকে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজোর পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজোর বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁরির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পূজো করা।
এই সব পূজোর মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। পূজোর উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তাঁর পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেওয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনও তা প্রচলিত আছে।
পূজোর উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দু’জন সখী। একজনকে সাজানো হয় লম্বা লেজ দিয়ে, তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে নীল পাগলের দলও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে পূজো হয়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা চড়ক সংক্রান্তির মেলা নামে অভিহিত।
হিন্দুধর্ম মতে চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখ মাসের প্রথম পর্যন্ত ভক্তরা মহাদেব শিবঠাকুরের আরাধনা করতে থাকেন। মহাদেবের সন্তুষ্টি লাভের আশায় সপ্তাহব্যাপী নানান পূজোর আয়োজন করেন তাঁরা। ফলপূজো, কাদা পূজো, নীল পূজো সহ সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন পূজো পালন শেষে আয়োজন করা হয় গা শিউরে উঠা চড়ক পূজো।
চড়ক পূজোয় পিঠে বাণ ফুঁড়িয়ে চড়ক গাছের সঙ্গে বাশঁ দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক ধরনের চড়কায় ঝুলন্ত দড়ির সঙ্গে পিঠের বড়শি বেঁধে দেওয়া হয়। তখন বাণ বিদ্ধ সন্ন্যাসীরা শূণ্যে ঝুলতে থাকেন। রাতে নীল পূজোর পর সন্ন্যাসীরা উপোস থাকেন। পরদিন বিকালে চড়ক পূজো শেষেই উপোস ভাঙেন তাঁরা।
চড়ক পূজোর শুরুতে শিবের পাঁচালী পাঠক মন্ত্রপড়া শুরু করলে সন্ন্যাসীরা শিবধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান। স্নান শেষ করে মাটির কলসি ভরে জল আনেন তাঁরা। এরপর চড়ক গাছের গোড়ায় গোল হয়ে দাঁড়ান সন্ন্যাসীরা। আবার শিব পাঁচালী পাঠ করতে থাকেন বালা (শিবপাঁচালী পাঠক)। সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রণাম করে চলে যান ফাঁকা জায়গায়। সেখানেই তাদের বাণবিদ্ধ করা হয়। সন্ন্যাসীরা নিজের শরীর বড়শিতে বিঁধে চড়কগাছে ঝুলে শূণ্যে ঘুরতে থাকেন। আবার সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ ও করেন। এ অবস্থায় একহাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘুরাতে থাকেন আর অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছোড়েন এই ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা। তাঁদের বিশ্বাস জগতে যারা শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছেন বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাঁদের কে স্বর্গে যাওয়ার বর দেবেন।
চৈত্র সংক্রন্তির ৩/৪ দিন আগে থেকে শুরু হয় চড়কের প্রস্ততি। উৎসবের আমেজ শুরু হয় গ্রামের বারোয়ারি তলায়, শ্মশানে কিংবা গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায়। যেখানে আর যেভাবেই এই উৎসব উপস্থাপিত হোক না কেন এর মূল আবহ জুড়ে থাকে কৃষি দেবতা দেবাদি দেব শিবের আবাহন।মূলত শিবই এই উৎসবের মুখ্য। তাই শিবকে সন্তুষ্ট করাই পূজারীদের উদ্দেশ্য।
পশ্চিমবঙ্গের যে অঞ্চলগুলো মূলত কৃষিপ্রধান সেখানেই চড়কপূজা উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলার প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার শরীরে প্রবেশ করতে হলে এরকম উৎসবগুলোকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেই কেবল লৌকিক বাংলার আদিরূপ দেখা সম্ভব হবে।
বৈশাখী উৎসবে নিজেকে রঙ্গিয়ে নেবেন বাঙালি জাতি। চৈত্র মাসের শেষ দিনটিতে ফেলা আসা বছরের হিসাবের খাতাকে লোকাচার-পার্বণে বিদায় জানানো হবে। নতুন করে উদ্যোম ও মঙ্গল প্রত্যাশায় নতুন বছর কে স্বাগত জানাতে প্রস্তত হবে বাঙালি। চৈত্র সংক্রান্তি বিশেষ লোক উৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি প্রধানত হিন্দু সম্প্রাদায়ের উৎসব হলে ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষজনের কাছে এক বৃহত্তর লোক উৎসবে পরিণত হয়েছে কালক্রমে। চৈত্র সংক্রান্তি এখন কেবল কোন ধর্ম বা মতের মধ্যে আবদ্ধ নয় তা রুপ নিয়েছে এক সর্বজনীন লোকউৎসবে।
চৈত্র সংক্রান্তির আসল আর্কষণ থাকে চড়ক পূজো। এই চড়ক পুজোকে কেন্দ্র করে দেশের অনেক জায়গায় বসে মেলা।
সূর্যাস্তের সাথে সাথে নানান আচার অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে যেমন বিদায় জানানো হবে চৈত্র কে, তেমনি প্রস্তুতি নেবে চৈত্রের শেষ রাতের প্রহরে সূর্য উদয়ের সাথে সাথে নববর্ষের বৈশাখ কে বরণ করে নিতে।