মনঃসংযোগ শব্দটার সাথে “মন”’এর সংযোগ অপরিসীম ।
এবার আসি, মন বলতে আমরা কী বুঝি ? মন মানে মানব মস্তিষ্কের এক বিশেষ ধরনের ক্রিয়া । যাকে আমরা অন্য ভাষায় চিন্তা করা বলি । এই চিন্তনক্রিয়ার সামগ্রিক আধারই হল মন । আবার অনেক বিদগ্ধজনের মতে, চিন্তন মানে মানসিক ক্রিয়া । তবে যাই হোক মন বলতে বোঝায়, বুদ্ধি ও বিবেকবোধের একটি সমষ্টিগত রূপ যা চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা, কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় । মন হল এমন কিছু যা নিজের অবস্থা এবং ক্রিয়াগুলি সম্পর্কে সচেতন । মন বলতে চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা, — এই মানসিক কাজগুলোর সমষ্টিগত রূপ বোঝায় । অন্যদিকে মন ও চেতনা এক নয় । চেতনা হল মনের স্বরূপ লক্ষণ । মনের স্বরূপ লক্ষণ হল চেতনা, যার থেকে মনকে জড় থেকে আলাদা করা হয় ।
মনঃসংযোগ বা মানসিক একাগ্রতা কোনো না কোনোভাবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । হেঁশেলে যে গৃহবধূ রান্না করে, বাড়ি তৈরীর যে নকশা বানায় আর্কিটেক্ট, যিনি ঘড়ি মেরামত করেন, এদের প্রত্যেককে গভীর মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করতে হয় । সুতরাং কোনো কাজে মন বসানোই হচ্ছে মনঃসংযোগ । মনঃসংযোগ বাড়াতে কয়েকটি বিষয়ের কথা এখানে উল্লেখ করা দরকার । যেমন ছবি আঁকা, গান করা, মাটির কাজ, বই পড়া, প্রবন্ধ লেখা, রান্না করা, সাইকেল বা মোটর সাইকেল ধোওয়া, জানালা মোছা, বাড়ির বাগানে কাজ করা, ফটো তোলা, বেড়াল-কুকুরের যত্নাদি করা, ইত্যাদি মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে । সুতরাং বলা চলে মনঃসংযোগ শব্দটার মধ্যে আছে মনকে কোনো কিছুর সাথে সংযুক্ত করার প্রশ্ন ! মন দিয়ে কাজ করার প্রশ্ন !
প্রাত্যহিক জীবনে মনঃসংযোগ নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে । “জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ” যে কোনো কাজ যথাযথভাবে সম্পাদন করতে গেলে মানসিক একাগ্রতা আবশ্যিক । মানসিক ও শারীরিক ক্রিয়াকলাপে একাগ্রতা অনুশীলনের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি তার জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারে ।
মনের সঙ্গে জৈবিক চাহিদার একটা সম্পর্ক রয়েছে । মন একটি আধ্যাত্মিক ধারণা যেটা মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, স্পর্শ করতে পারে না । মানুষের জৈবিক চাহিদাগুলির মধ্যে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম, যৌনতা, রেচন, প্রভূতি । এই চাহিদাগুলি যখন পূরণ হয়, তখন মানুষের মানবিক নানান কার্যাবলী সম্পন্ন করতে থাকে । তাই মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মানুষের জৈবিক চাহিদাগুলি পূরণ করেই মানবিক বৈশিষ্ট্যের দিকে অগ্রসর হওয়া । সাংস্কৃতিক চর্চা, বৈজ্ঞানিক চর্চা, দার্শনিক চর্চা, সাহিত্য চর্চা, গল্প করা, আয়েশ করা, ইত্যাদি মানবিক আচরণের নিদর্শন । এইসব কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রেমপ্রীতি, স্নেহ, ভালবাসা, মমতা ও প্রশান্তি প্রভূতি ধনাত্মক বিষয়গুলি বিকশিত হয় এবং ক্রোধ, হিংসা, প্রভূতি ঋণাত্মক বিষয়গুলি দূরীভূত হয় । তবে জৈবিক চাহিদাগুলি পূরণ না হলে মানুষ মানবিক চাহিদাগুলি পূরণ করার জন্য অগ্রসর হতে চায় না । যেমন যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র ব্যাপকভাবে রয়েছে সেখানে সংগীত চর্চা, বিজ্ঞান চর্চা, সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না ।
দেখা গেছে মন নিয়ে অনেক সংগীত রচিত হয়েছে । একটি জনপ্রিয় গান, “মন বোঝে না, মন শোনে না । কারে বলি এ মনের কথা । মন বোঝে না, মন সহে না । কারে বলি এ ব্যাকুলতা ।“ তাই মন বলতে আমরা বুঝি, “চিন্তার সমষ্টি । চিন্তা ছাড়া মনের কোনো অস্তিত্ব নেই ।“ আবার অনেকে বলেন, “মন বলে কিছু নেই । মনের প্রবৃত্তির কোনো কিছুই শরীর থেকে ভিন্ন নয় । মানুষের মস্তিস্ক থেকে উদ্ভূত শরীরবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মন গড়ে ওঠে ।“ মন নিয়ে ব্যাখার শেষ নেই । এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মন কোথায় থাকে ? মস্তিস্ক ও অন্তরের সংযোগ স্থাপনকারী হচ্ছে মন । আমরা জানি, মস্তিস্কের বড় প্যারামিটার হচ্ছে বুদ্ধি । আর অন্য প্যারামিটারগুলি হচ্ছে ধ্যান, চিন্তা, খেয়াল, ইত্যাদি । অন্যদিকে অন্তরের প্যারামিটারগুলি হচ্ছে দয়া, মায়া, হিংসা, লোভ, রাগ, লজ্জাশীলতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, ইত্যাদি । সুতরাং মস্তিস্কের সাথে অন্তরের সম্পর্কও উল্লেখযোগ্য । অন্যদিকে মন ও মনঃসংযোগের সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান ।
ইদানীং বিশেষ করে ছোটদের মনঃসংযোগ বিঘ্নিত হওয়ার কারণগুলির মধ্যে অন্যতম মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশন, ইত্যাদি । তার উপর রয়েছে সোসাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক, টাইমলাইন, হোয়াটসআপ, মেসেঞ্জার, ইত্যাদির লাগামছাড়া ব্যবহার । এইসব ব্যবহারের ফলে ছোটদের মন, ভাবনা, ধারণা, মূল্যবোধে বিরূপ প্রভাব পড়ছে । যার ফলে নিজেদের কাজকর্মের প্রতি শিথিলতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা মাথাচাড়া দিচ্ছে । এইজন্য চাই মানসিক চেতনার জাগরণ – সেটা হচ্ছে সতর্কতা, একাগ্রতা এবং ইচ্ছাশক্তি । অভিভাবকদেরও তাদের সন্তানদের প্রতি ইতিবাচক শ্যেন দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে ছেলেমেয়েরা বিপথে না যায় । ছোটদের মনঃসংযোগে যেন বিঘ্ন না ঘটে ।
মনঃসংযোগ বাড়াতে সমাজের অনেক মানুষ ধ্যান করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন । ধ্যান করলে মনকে প্রথমে বাইরের বিষয় থেকে বিমুক্ত করে তারপর তাকে অন্তর্মুখী করতে হবে । যদিও এই অন্তর্মুখীকরণ একটা কঠিন কাজ । সুতরাং ধ্যান মনঃসংযোগ হল ইচ্ছাশক্তির কাজ । এইজন্য ধ্যানের ক্ষেত্রে বসার উপর গুরুত্ব যথেষ্ট । শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার ব্যাপারটা উল্লেখযোগ্য । যার জন্য অনেক ব্যক্তি প্রথমে শ্বাস নাক দিয়ে টেনে আবার পেট খালি করে ছাড়তে বলে । এতেও নাকি মনঃসংযোগ বাড়ায় ।
প্রাচীন ভারতে ঋষিরা অতীন্দ্রিয় সাক্ষাৎকার লাভের নানাবিধ আধ্যাত্মিক প্রকরণ উদ্ভাবন করেছিলেন, যাদের “যোগ” বলত । মনঃসংযোগের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ এইসব আধ্যাত্মিক প্রকরণের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য । উপনিষদগুলি যোগীর মনকে ‘অবিরত ধ্যান সহযোগে শাণিত শর’এর সঙ্গে তুলনা করেছেন । মনঃসংযোগের এইসব আধ্যাত্মিক কৌশলের অনেকগুলি স্তর আছে, যেমন – ধ্যান ও সমাধি । এমনকি স্বামী বিবেকানন্দ ‘মেডিটেশন’ নাম দিয়ে ধ্যানের পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন । মেডিটেশনের উপকারিতা নিয়ে লিখলে একটা লম্বা লিষ্ট হবে । ছোট করে বলা যায়, মেডিটেশন শরীরে একটা শান্ত ভাব নিয়ে আসে । শরীরে অস্থিরতা কমে । কাজের প্রতি একাগ্রতা বাড়ে । মেডিটেশন মানুষের ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে । সুতরাং “যোগ” মানুষের মনোযোগ বাড়িয়ে তুলতে সহযোগিতা করে ।
এখন দেখা যাক কীভাবে মনঃসংযোগ বাড়ানো যায় ? মনঃসংযোগ নিয়ে অনেক কথা প্রনিধানযোগ্য । কর্মক্ষেত্রে অনেকের মুখে শোনা যায়, কাজে মন বসছে না । সেক্ষেত্রে মনঃসংযোগ কম বলেই এটা হতে পারে । সুতরাং মনঃসংযোগ ফিরিয়ে আনতে তৎপর হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় । মনঃসংযোগ বাড়াতে স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখাটা জরুরি । স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে মানসিক স্থিতি ভাল থাকে না । মুড অফ থাকে । প্রয়োজনে হাঁটা চলা, নতুবা ব্যায়াম করা, তাতে শরীর হাল্কা থাকবে ও কাজে মন বসবে । খাওয়া দাওয়া ঠিক রাখাটা অবশ্যাম্ভাবী । পেটে খিদে থাকলে কোনো কিছুতে মন বসবে না । তারপর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলে সেই বিঘ্নকে খুঁজে বের করে দ্রুত সারানোর ব্যবস্থা করাটা দরকার । তবেই মনঃসংযোগ বাড়বে । একটানা কাজ না করে কাজের ফাঁকে ব্রেক নিলে একঘেয়েমি কমে । একসঙ্গে একগাদা কাজ করতে গেলে তাতে টেনশন বাড়বে । বরং মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটাবে । স্ট্রেস থেকে দূরে থাকাটা খুব দরকার । স্ট্রেস যত বাড়বে তত কমবে পারফেকশন । ফলে কোনো কাজই ঠিকঠাক মতো সম্পূর্ণ হবে না ।
পরিশেষে যেটা বলা যায়, মনঃসংযোগের সাথে মনের সম্পর্ক অপরিসীম । একটা মানুষের জীবনে মনঃসংযোগ থাকাটা ভীষণ দরকার । মনঃসংযোগের মাধ্যমে ক্রিয়া-কাণ্ডগুলির সুফল অবধারিত । (সূত্রঃ তথ্য সংগৃহীত ও উদ্বোধন, আশ্বিন-১৪২৮, পৃ-৭২৯) ।