কঙ্কাবতীর দুঃসাহস (ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রথম পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

0
724

গাঁয়ের নাম চড়ুইডাঙা । তারপর একটু থেমে কঙ্কাবতী বলল,পোস্ট অফিসের নাম শিলাইদহ, থানা-নিয়ামতপুর, জেলা – মুর্শিদাবাদ । এবার আমার ভাতার টাকাটা দিন ?
এখানে টিপসই দিন ?
“আমি টিপসই দেওয়া পছন্দ করি না ।“ তারপর টেবিলের উল্টোদিকে বসা ষণ্ডা মার্কা চেহারার লোকটার হাত থেকে কলমটা একরকম ছিনিয়ে নিয়ে খাতায় স্বাক্ষর করে দিলো । সই করার সময় কঙ্কাবতী নিজের চোখে দেখতে পেলো, তার নামের পাশে এক হাজার টাকা লেখা । রেজিস্টারে লেখা দেখে কঙ্কাবতী নিশ্চিত, “নারী ভাতা বাবদ সে এক হাজার টাকা পাচ্ছে !”
ষণ্ডা মার্কা লোকটা কঙ্কাবতীর হাতে আটশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে লাইনে দাঁড়ানো অপরজনকে ডাকল ।
টাকা গণনা করার পর কঙ্কাবতির চোখ চড়কগাছ ! দুশো টাকা কম ! সঙ্গে সঙ্গে চোখ গরম করে কঙ্কাবতী কৈফয়িৎ চাইল, “হিতেনদা, আমি আটশ টাকা পেয়েছি ! এখনও দুশো টাকা বাকী ।“
ঐ টাকাই তোমার প্রাপ্য ।
“মানে, আপনি কী বলতে চাইছেন । আমি দুশো টাকা কম নিয়ে বাড়ি যাবো ? পুরো এক হাজার টাকা আমাকে বুঝিয়ে দিন । নতুবা আমি এখান থেকে নড়ছি না ।“ কঙ্কাবতী নাছোড়বান্দা !
আচ্ছা জ্বালাতন দেখছি ? তুমি আমাদের কাজে বাধা দিচ্ছো ? আমাদের কাজে বাধা দিলে আমরা তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবো ?
হিম্মৎ থাকলে আমাকে টাকা বুঝিয়ে না দিয়ে এখান থেকে সরান, তবে বুঝবো আপনাদের গুণ্ডামির শক্তি ?
তুমি কী আমাদের চ্যালেঞ্জ দিচ্ছো ?
আমার বাকী দুশো টাকা না দিলে ঠিক তাই, আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি ?
হঠাৎ হিতেনের একজন সাগরেদ কঙ্কাবতীর ডান হাত হ্যাঁচকা টান দিয়ে চিল্লিয়ে অসভ্য ভাষায় বলল, “পালাবি ? না পালালে তোর কী হবে জানিস ? কেউ তোকে বাঁচাতে আসবে না ?”
হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কঙ্কাবতী চিল্লিয়ে বলল, “আমি না পালালে কী হবে তুই আগে সেই কথা শোনা, তারপর আমি কী করব সেটা শোনাচ্ছি !”
“তোর মেয়েদের তুলে নিয়ে জঙ্গলে ফুর্তি করবো ।“
শোনা মাত্র কঙ্কাবতী পায়ের চটি খুলে হিতেনের সাগরেদের গালে সজোরে কয়েক ঘা এমনভাবে মারলো, মারের আঘাতে বেচারা মাটিতে গড়াগড়ি !
উপস্থিত সমস্ত মহিলারা একজোট হয়ে হিতেনের সাগরেদকে টাইট দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল । এতক্ষণ তারা কঙ্কাবতীর সঙ্গে কথা কাটাকাটির দৃশ্য দেখছিল আর প্রমাদ গুণছিল, কখন তারা কঙ্কাবতীর সঙ্গে সামিল হবে ! হিতেনের গুন্ডামি তারা মেনে নিতে পারছিল না । কিন্তু সাহস করে হিতেনের গুন্ডামির যোগ্য জবাবও দিতে পারছিল না । তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল । সুযোগ পেয়ে অন্যান্য মহিলারাও ঝাঁপিয়ে পড়ল । তারা রীতিমতো টাকা ফেরতের জন্য সোচ্চার !
অবস্থা বেগতিক বুঝে হিতেন স্পটে এসে সমস্ত মহিলাদের উদ্দেশে হাত জোড় করে বলল, “যারা টাকা কম পেয়েছেন, ফেরত নিয়ে যান ।“
চড়ুইডাঙার বিনোদের মা এগিয়ে এসে কঙ্কাবতীকে পরামর্শ দিলেন, “রাত্রিতে সাবধানে থেকো । হিতেন একজন অসভ্য ও নোংরা মনের মানুষ । এলাকার মানুষের অনেক ক্ষতি করেছে । রাস্তা থেকে বয়স্থা মেয়েদের তুলে তাদের ইজ্জ্বত নিয়ে মজা করা তার এক ধরনের আনন্দ । রাজনৈতিক দলের ও কিছু মন্ত্রীদের ছত্রছায়ায় থাকার জন্য এহেন জঘন্য কাজ করেও সে পার পেয়ে যাচ্ছে । কেউ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না । এমনকি ভুক্তভোগী মেয়েদের অভিভাবকেরাও না ! সুতরাং তোমাকে তারা সহজে ছেড়ে দেবে না !” বিনোদের মা আরও জোর দিয়ে বললেন, “বদলা হিতেন নেবেই ।“
কঙ্কাবতীর দুঃসাহস যথেষ্ট । সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার মহিলা না । ইতিপূর্বে তার নিজের মেয়েদের চলাফেরার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা কঙ্কাবতীকে শক্ত হাতে সামলাতে হয়েছে । তাই বিনোদের মাকে কঙ্কাবতী অভয় দিয়ে বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না । হারামজাদাগুলোকে কীভাবে টাইট দিতে হয়, সেই কৌশল আমার জানা আছে । তা ছাড়া হারামজাদাগুলো আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না । গুণ্ডামি করে আমাদের হকের টাকা মারবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না । সেইজন্য আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না । তবে এটা ঠিক, হিতেনের সাগরেদকে গণধোলাই দেওয়ার জন্য আমরা টাকাটা ফেরত পেলাম । নতুবা এতগুলি টাকা গায়েব করে দিতো ।“
বাড়ি ফিরতে কঙ্কাবতীর সন্ধ্যা ।
বাড়ি ফিরে লক্ষ করলো তার ছোট মেয়ে বিপাশা হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দিয়েছে । কঙ্কাবতীর হাতে মুরগির মাংস । ছোট মেয়ের উদ্দেশে কঙ্কাবতি বলল, “আজ রাত্রিতে মাংস ভাত হবে ।“ কঙ্কাবতীর ছোট মেয়ে সর্বদা মায়ের ন্যাওটা । মায়ের কাজে হাত লাগাতে সে সর্বদা চনমনে ।
মাংস-ভাতের কথা শুনে কঙ্কাবতীর ছেলেমেয়েরা খুশীতে টগবগ ।
ঘর থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল মুখে কঙ্কাবতীকে অনিন্দ বলল, “মাংস আনার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ।“
কঙ্কাবতীর ভরা সংসার । তার নিজের বয়স অনেক । কিন্তু চেহারাখানা তার চৌকশ । যেমন এক মাথা চুল । তেমনি তার শারীরিক গঠন । তার চেহারা বা চালচলন দেখলে কেউ বলতে সাহস পাবে না, কঙ্কাবতী ছয় সন্তানের জননী । তাক লাগানো চেহারা । যে কোনো বয়সের পুরুষের চোখে পড়ার মতো তার শরীর-গতর । হৃষ্টপুষ্ট শারীরিক স্থিতি । লম্বা যেমনি, তেমনি তার তাগড়াই চেহারা । চলাফেরায় সাবলীল । কিছুটা স্বাধীনচেতা । ভয়ডর খুব কম । অল্প বয়সের ছেলেপুলে তাকে উত্ত্যক্ত করলে, সোজা কান ধরে শুনিয়ে দেয়, “সে তার মায়ের বয়সী ।“ কিন্তু কঙ্কাবতী পড়াশুনায় নবডঙ্কা ! অষ্টম শ্রণী পর্যন্ত । অল্প বয়সে অনিন্দের সঙ্গে বিয়ে । তারপর প্রথম দুটি ছেলে এবং পরপর চারটি মেয়ে । দুজন ছেলে হচ্ছে – যথাক্রমে রূপন ও ঘোতন । বড় মেয়ে তানিশা, মেজ মনীষা, সেজ অনীশা ও ছোট বিপাশা । বড় ছেলে তেমন লেখাপড়া শেখেনি । যার জন্য সংসারের কাজে বড় ছেলে নিয়োজিত । ছোট ছেলে ঘোতন । গাঁয়ে ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় তার অবাধ ঘোরাঘুরি । ঘোতনকে এলাকায় সবাই চেনে । বিনা কারণে যেখানে-সেখানে ঘোতনের অবাধ বিচরণ, অনিন্দের একেবারেই অপছন্দ ।
চার মেয়েই ডাগর-ডোগর । কঙ্কাবতীর চার মেয়ের চরিত্র চার রকমের ।
অনিন্দের উপার্জনের জায়গাটা শক্তপোক্ত নয়, নড়বড়ে । ট্রেনের হকারি । আর মাঠে আট বিঘে চাষের জমি । তা ছাড়া অনিন্দ শারীরিকভাবে দুর্বল । নানান অসুখে জর্জরিত । যার জন্য উপার্জনের কথা মাথায় রেখে কঙ্কাবতীকে বেশীর ভাগ সময় ভ্যান রিক্সায় সব্জি বিক্রি করতে গাঁয়ে বের হতে হয় । পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে তার সব্জি বিক্রি । সব খরচা বাদ দিয়ে দিনে মোটামুটি চারশ টাকা থাকে । বিয়ের প্রথম দিকে তাকে সংসারের খরচা নিয়ে ভাবতে হত না । অনিন্দ সব দিক সামলাতো । কিন্তু পরবর্তীতে কঠিন ব্যামোতে পড়েছিল অনিন্দ, যেখানে ছিল জীবন-মরণের প্রশ্ন । ডাক্তারের অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই সময় অনিন্দ প্রাণে বেঁচে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল । তখনই ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, অনিন্দকে দিয়ে পরিশ্রমের কাজ আর করানো যাবে না । সেই থেকে অনিন্দ ট্রেনের হকার । হকারিতে আয় খুব কম । অথচ বাড়িতে বড় বড় ছেলে মেয়ে । নিষ্কর্মার ঢেঁকি । অথচ তাদের খাওয়া-দাওয়ার খরচা এখন ঊর্ধ্বগতি ।
পড়াশুনায় কেউ আগ্রহী না । শুধুমাত্র ছোট মেয়ে বিপাশা স্কুলে যাচ্ছে । সামনে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা ! বড় ছেলে রূপন বাবার অসুখের জন্য বেশীদূর পড়াশুনা করতে পারেনি । ঘোতন কলেজে উঠে নানান অশান্তিতে জড়িয়ে পড়ে । স্নাতক ডিগ্রি তার কপালে জোটেনি । রূপন বিবাহিত । রূপনকে বিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রামে । রূপনের একটি ছেলে । রূপন এখন ঘোর সংসারী । মাঠে চাষবাস নিয়ে থাকে । রূপনের চেষ্টায় মাঠে এখন চাষের জমি বারো বিঘা । জমিতে শুধুমাত্র ধান চাষ । ফলে বছরের খাওয়ার চাল, চাষের জমি থেকে উঠে আসে । সংসার খরচের নগদ টাকার জন্য কঙ্কাবতীর নিরলস কসরত ।
রূপন সাদামাটা মানুষ । মাঠের জমিতে চাষ-আবাদ ছাড়া গাঁয়ের কোনো সাতেপাঁচে থাকে না । রূপনের বৌ তেমনি । ঘর সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে সামলায় । চারটে ননদ । কখনও সংসারের কাজে ননদদের বিরক্ত করে না । মুখ বুজে হেঁশেল সামলায় । তাই কঙ্কাবতী গাঁয়ের মানুষদের অহরহ বলে, “অনেক ভাগ্য করে আমরা বৌমা পেয়েছি যে কিনা পুরোপুরি ঘর সংসারী । ঘরের সমস্ত কাজ নিজে হাতে সামলায় ।“ বড় বৌমার প্রশংসা প্রসঙ্গে অনিন্দ আরও একটু বাড়িয়ে বলে, “তার বড় বৌমা বাড়ির লক্ষ্মী । শত খুঁজলেও দ্বিতীয়টি মেলা ভার !”
কঙ্কাবতীর হয়েছে জ্বালা ! নিজের তাগড়াই চেহারা । দৈহিক চাহিদা অত্যধিক বেশী । কিন্তু ঘরের হাঁদারাম মরদটা অকর্মার ঢেঁকি ! তবুও তার হা-পিত্যেশ নেই । ছোঁকছোঁক বাতিক নেই । গায়ে পড়ে কেউ ভাব জমাতে এলে, কঙ্কাবতীর হুমকি খেয়ে তারা পালিয়ে বাঁচে । কাউকে ডরায় না । রাতে অনিন্দের সাথে এক বিছানায় শুয়ে শান্তি না থাকায় খুব ভোরে কাজে বের হয়ে যায় । চড়ুইডাঙা গ্রাম থেকে স্টেশন অনেকটা দূর ! পায়ে হাঁটা রাস্তা । স্টেশন বলা ভুল, হল্ট । মিয়াগ্রাম হল্ট । ভোরের প্রথম ট্রেন ধরে সোজা সালার স্টেশন । সেখান থেকে পাইকারি দরে সব্জি কিনে পরের ট্রেনে বাড়ি ফিরতে প্রায় সকাল আটটা । তারপর সেদ্ধ-ভাত খেয়ে ভ্যানে সব্জিগুলি সাজিয়ে গাঁয়ে বের হয় বিক্রি করার জন্যে । এগ্রাম-সেগ্রাম ঘুরে সব্জি বিক্রি । তাই বাড়ি ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায় । বাড়ি ফিরে বৌমার সাথে গাল-গপ্প । মেয়েদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাসা ! গেরস্থালির কাজ । এসবের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । তবুও ধরাবাঁধা রুটিনের বাইরে কয়েকটা অঘটন তার জীবনে ঘটে গেছে, যেটা ভাবলে তার গা শিউরে উঠে ! গায়ে কাঁটা দেয় !
সেটা বৈশাখ মাসের সংক্রান্তি ।
কঙ্কাবতীর সব্জি বিক্রি প্রায় শেষ । আর কিছুটা সব্জি অবশিষ্ট রয়েছে । বিশেষ করে বেগুন, কলমি শাক, ঢেঁড়শ, পটল, একফালি কুমড়ো, টমাটো, কাঁচা লঙ্কা, ইত্যাদি । তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে । পাশের গ্রাম হরিবল্লভপুর । কঙ্কাবতী যে গাঁয়ে সব্জি বিক্রি করছিল, সেই গ্রাম থেকে হরিবল্লভপুর যেতে খানিকটা হাঁটা পথ ! তবে মাটির রাস্তা কিন্তু অনেকটা প্রশস্ত । ঐ রাস্তায় গরুর গাড়ির আনাগোনা বেশী । ভ্যান নিয়ে কঙ্কাবতী হরিবল্লভপুরের দিকে এগোচ্ছে । তার ধারণা, হরিবল্লভপুরে গেলে তার সমস্ত সব্জি বিক্রি হয়ে যাবে । এতগুলি সব্জি অবিক্রি অবস্থায় বাড়িতে ফেরত নিয়ে গেলে তার লোকসান । কেননা, সব্জিগুলি গরমে প্রায় শুকিয়ে গেছে । পরেরদিন ঐগুলি বিক্রি করা কঠিন । অবশেষে সব্জিগুলি জঙ্গলে ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না । তাই ছুটলো হরিবল্লভপুর গ্রামের দিকে । রাস্তা ধরে এগোচ্ছে । এমন সময় আকাশে কালো মেঘ । হঠাৎ মেঘ । নিমেষের মধ্যে কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেলো । হরিবল্লভপুর পৌঁছাতে কঙ্কাবতীর অর্ধেক রাস্তা তখনও বাকী । ঝড়ের পূর্বাভাস ! ভ্যান নিয়ে জোরে পা চালায় কঙ্কাবতী ।
শুরু হল বিদ্যুৎ চমকানো । আর প্রচণ্ড ঝড় । কঙ্কাবতীর মতে, নিঃসন্দেহে ঘূর্ণিঝড় ! লাগামছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে ওলট-পালট অবস্থা । আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা । কালো মেঘ, তার উপর মেঘের গর্জনের দাপট ! অচিরেই চারিদিকে অন্ধকার নেমে এলো । তখনও সূর্য অস্ত যায়নি, অথচ চারিদিকে অন্ধকার । ঝড়ের তীব্রতায় রাস্তা দিয়ে হাঁটা দায় ! ঝড়ের গতিবেগ এতটাই বেশী, যার জন্য ভ্যান রিক্সা ঠেলতে পারছে না কঙ্কাবতী । ঝড়ের দাপটে নিজেকে সামলানোও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে কঙ্কাবতীর পক্ষে । তার উপর ভ্যান রিক্সা সামলানো ! ঝড়ের সো-সো শব্দ ! ক্ষমতাশালী প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড ! রাস্তায় একটা লোক নেই । চারিদিক সুনসান । এই রাস্তা দিয়ে সাধারণত মানুষের যাতায়াত খুব কম । হরিবল্লভপুরের মানুষ পূর্বদিকের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতে অভ্যস্ত । এই রাস্তাটা খুব একটা কাজে লাগে না । যার জন্য রাস্তাটার কোনো সংস্কার নেই । এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা । মাঠের ফসল তোলার সময় গরুর গাড়ির যাতায়াত যথেষ্ট । যার জন্য রাস্তাটা খানাখন্দে ভর্তি । প্রলয়ংকর ঘূর্ণীঝড়ে কঙ্কাবতীর ভ্যান রিক্সার উপরের সব্জি মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি । এবার সে ভ্যান রিক্সা আর ঠেলতে পারছে না । অন্যদিকে পরনের শাড়ি ঠিক রাখতে পারছে না । ঝড়ো হাওয়ায় বুকের উপর থেকে অনেকক্ষণ আগেই শাড়ি উধাও । ঝড়ের তাণ্ডবে সে নিজেকে বাঁচাতে তটস্থ ! তার উপর ভ্যান রিক্সা আগলানো । এসবের মাঝে তার পরনের শাড়ি সামলানোর পরস্থিতি নেই ।
শুরু হল ঘূর্ণিঝড়ের সাথে ভারী বৃষ্টি ! ঝড়ের ধ্বংসলীলায় চারিদিকে গাছগাছালি ভেঙ্গে পর্যুদস্ত । সামনে রাস্তার উপরে কাটাজাতীয় একটি বাবলা গাছ পড়ে থাকতে দেখলো । কঙ্কাবতী কোনোরকমে গাছটা সরিয়ে এগিয়ে গেলো । এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই । হরিবল্লভপুর গাঁয়ে ঢুকে তবে রেহাই । কিন্তু হরিবল্লভপুর পৌঁছাতে এখনও অনেকটা দূর ! ঢেলে বৃষ্টি । বৃষ্টিতে কঙ্কাবতীর শরীর ভিজে একশা !
ঝড় কিছুটা থিতিয়ে গেছে । কিন্তু বৃষ্টির বর্ষণ সমানে চলছে । কঙ্কাবতী বৃষ্টিতে ভিজে নদীতে স্নান করার ন্যায় । তার শারীরিক গঠন এতটাই সুন্দর, যার জন্য বৃষ্টিতে ভেজার পর তার শরীরের দ্যুতির বিস্ফোরণ আকর্ষণীয় ।
উল্টোদিক থেকে নিয়ামতপুর থানা থেকে বাড়ি ফিরছে পঞ্চায়েতের রক্ষিতবাবু । তাঁর বয়স কঙ্কাবতীর কাছাকাছি । রক্ষিতবাবুর বাড়ি চড়ুইডাঙার পাশের গ্রাম পল্লীদহ গাঁয়ে । তিনি সেখানকার পঞ্চায়েত । পঞ্চায়েত হলে কী হবে ? কঙ্কাবতীর রূপে তিনি মুগ্ধ । কয়েকবার একথাটা বলা হয়ে গেছে । কঙ্কাবতী ঐসব কথার গুরুত্ব কোনোদিনও দেয়নি, সুতরাং রক্ষিতবাবুর কথারও গুরুত্ব দেয়নি । বরং দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে । এমনকি রক্ষিতবাবু কঙ্কাবতীকে পঞ্চায়েতের কাজে ঢোকানোর প্রলোভনও দেখিয়েছিল । কিন্তু চালাক কঙ্কাবতী ঐসব প্রলোভনে পা দেয়নি । কঙ্কাবতী জানতো, এইসবের পেছনে রক্ষিতবাবুর অন্য ধান্দা রয়েছে । কারণ রক্ষিতবাবুর চরিত্র সম্বন্ধে কঙ্কাবতী ষোলোআনা অবগত । সেই কারণে রক্ষিতবাবুর ফাঁদে পা বাড়ায়নি । কঙ্কাবতী কানাঘুষো শুনেছে, পল্লীদহের শান্তি বিধবা বৌটার সঙ্গে রক্ষিতবাবুর কেলেঙ্কারির কেচ্ছা ! সেই খতরনাক লোকটাকে দেখে আতকে উঠল কঙ্কাবতী ! কঙ্কাবতী খুব দ্রুত তার পরনের শাড়ি গোছাতে শশব্যস্ত হয়ে উঠল ।
রক্ষিতবাবু প্রথমে বুঝতে পারেনি । কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলো, শাড়ি পরিহিত একজন হৃষ্টপুষ্ট মহিলা ভ্যান রিক্সার আড়ালে বসে রয়েছে । আকাশে তখনও মেঘের গর্জন । বৃষ্টি অনবরত চলছে । বৃষ্টির জলের ফোঁটা ভীষণ ঠাণ্ডা ! সূর্য দেবতা কালো মেঘে ঢাকা । কাছাকাছি এসেই রক্ষিতবাবু হাঁক ডাকলো, “কে ? কে ওখানে ?”
সাড়া না পেয়ে রাস্তার পাশে কঙ্কাবতীর কাছে গিয়ে তার ঘোমটা খুলে দিলো । আচমকা কঙ্কাবতীকে দেখে রক্ষিতবাবু আনন্দে উচ্ছ্বসিত । কঙ্কাবতীর ঘোমটা খুলে তাকে দেখে আনন্দে তার মুখ থেকে বের হল, “আমার অনেকদিনের স্বপ্নের রানীকে আজ সে হাতের মুঠোতে পেয়েছে ?”
কঙ্কাবতী পালাতে ব্যস্ত । এতক্ষণ ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কঙ্কাবতী কিছুটা শারীরিকভাবে কাহিল ? যার জন্য ছুটে পালাতেও হোঁচট খাচ্ছে । তবুও সে পালাতে মরিয়া । নতুবা এই নির্জন জায়গায় রক্ষিতবাবুর খপ্পরে পড়তে বাধ্য । অনেক যত্নে বাঁচিয়ে রাখা তার নারীসত্তার ধ্বংস অনিবার্য ।
( ক্রমশ)