মহিষাদলের রথের কথা : সৌরভকুমার ভূঞ্যা।

0
495

মহিষাদলের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম হল রথযাত্রা উৎসব। বর্তমানে সেই উৎসবের জৌলুস আগের থেকে অনেকটা কম। রথকে কেন্দ্র করে জনসমাগমও আগের তুলনায় কমে গেছে। তবুও এই রথযাত্রা নিয়ে মানুষের মধ্যে আলাদা একটা আবেগ ও উন্মাদনা রয়েছে। প্রাচীনত্ব আর ঐতিহ্যের বিচারে বিশেষ মর্যাদার দাবি রাখে মহিষাদলের রথ ও রথযাত্রা উৎসব।
মহিষাদলের রথযাত্রার ইতিহাস দুই শতাব্দীরও বেশি প্রাচীন। মহিষাদল রাজ পরিবার এই রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেন। ধর্মপ্রাণা রানী জানকী এই উৎসব চালু করেন, এই মত বেশি প্রচলিত হলেও অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে রানী জানকী নন, মতিলাল পাঁড়ে (উপাধ্যায়) এই রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেছিলেন।
মহিষাদল রাজ পরিবারের কুমার দেবপ্রসাদ গর্গ ১৩৭৬ বঙ্গাব্দে ‘ল্যাকেটু’ পত্রিকায় রথ নিয়ে দীর্ঘ্য একটি প্রতিবেদন লেখেন। সেখানে তিনি জানান রানী জানকী ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে এই রথ নির্মান করেন। এটি তৈরির খরচ দেখিয়েছেন ৬০০০০ সিক্কা। দেওয়ান আনন্দ ঘোষের ডাইরি উল্লেখ করে তিনি রথের যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে জানা যায় তখন চারতলা রথটির ছিল ১৭ টি চূড়া এবং ৩৪ টি লোহার চাকা। তাঁর তথ্য সত্যি ধরলে রানী জানকীই রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেছিলেন।


কিন্তু অনেক ঐতিহাসিকের মতে এই তথ্য সঠিক নয়। তাদের দাবি রথযাত্রা উৎসব চালু করেছিলেন মতিলাল পাঁড়ে। অপুত্রক অবস্থায় রাজা আনন্দলাল ও পরে রানী জানকী মারা গেলে নিজেকে তাদের পোষ্যপুত্র হিসেবে দাবি করে মতিলাল সিংহাসনে বসেন। কিন্তু রাজপরিবার তাঁর এই দাবি মানে না। এই নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও হয়। মতিলাল বর্তমান গুন্ডিচাবাটির কাছে আলাদা অট্টালিকা নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ১৭ চূড়া বিশিষ্ট রথটি নির্মাণ করেন। মহিষাদলের রাজ পরিবারের ঐতিহাস নিয়ে প্রথম কোনো প্রামান্য গ্রন্থ হল ভগবতীচরণ প্রধানের লেখা ‘মহিষাদল রাজবংশ’। এই বইতে তিনি পরিস্কারভাবে বলেছেন, “মতিলাল রাজকার্যে প্রবৃত্ত হইয়া সর্বপ্রথম গোপালের নিমিত্ত সপ্তদশ চূড়ক সমন্বিত বৃহৎ দারুময় রথ নির্মাণ করেন। জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুকরণে প্রতি বর্ষের আষাড়ীয় শুক্লা দ্বিতীয়াতে ঐ রথোৎসব গুঞ্চাবাটী নামক প্রাসাদে সপ্তাহকাল ব্যাপিয়া সম্পন্ন হইয়া থাকে। প্রজাগণ এই উৎসবের সমস্ত ব্যায়ভার বহন করিতে স্বীকৃত হয়।” উল্লেখ্য বইটি তিনি রাজা জ্যোতিঃপ্রসাদ গর্গকে উৎসর্গ করেছেন। সবচেয়ে লক্ষণীয়, এই বইয়ের ‘বিজ্ঞাপন’ শিরোনামের লেখাটি লেখক এই বলে শেষ করেছেন, “এই পুস্তক মুদ্রাঙ্কনকালে মহিষাদল স্টেটের মহামান্য ম্যানেজার শ্রীযুক্ত বাবু নীলমণি মণ্ডল মহাশয় ইহার আদ্যোপান্ত পাঠ শ্রবণ করিয়া মুদ্রাঙ্কণন অনুমতি দান না করিলে মুদ্রিত ও পাঠকবর্গের নেত্রপথে উপস্থিত হইত না। এজন্য তাঁহার নিকট চিরকৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ রহিলাম।” রথ নিয়ে ভগবতীচরণ প্রধানের তথ্যে নীলমণি মণ্ডল কিংবা জ্যোতিপ্রসাদ গর্গের আপত্তি থাকলে তা নিশ্চয়ই এই বইতে ছাপা হত না। এর থেকে পরিস্কার রানী জানকী নন, মতিলাল পাঁড়ে রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেছিলেন। উল্লেখ্য, ভগবতীচরণ প্রধানের বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে। আর কুমার দেবপ্রসাদ গর্গ রথ নিয়ে লেখাটি লিখেছিলেন তার প্রায় ৭২ বছর পর, ১৯৬৯-৭০ এর সময়। এছাড়াও আরও অনেক ঐতিহাসিক ও গবেষক প্রামাণ্য তথ্য দিয়ে ভগবতীচরণ প্রধানের তথ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।


যাইহোক, প্রথমে নির্মিত রথটির বেশ কয়েকবার সংস্কার হয়েছে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজা লছমনপ্রসাদের ফরাসি বন্ধু মঁসিয়ে পেরু রথ দেখতে আসেন। তিনি রথটি সংস্কারের একটি নকশা দেন। সেই মতো রথটির ১৭টি চূড়া কমিয়ে ১৩ চূড়া করা হয়। প্রত্যেক তলার চারপাশে ঘুর বারান্দা করা হয় এবং চার কোণে চারজন ঋষির মূর্তি বসান হয়। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ রথের সামনে দুটো শ্বেতহস্তী যোগ করেন। সেই রথ আজও চলছে। বছর দুয়েক আগে রথটির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। এমনকি অনেকে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করেন। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের বর্তমান পরিবহন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর আর্থিক সাহায্যে ও মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতির সহযোগিতায় রথটির আমুল সংস্কার করে তাকে প্রায় নতুনের মতো করে গড়ে তোলা হয়। পূর্বে রাজ পরিবার রথযাত্রা উৎসব পরিচালনা করত। বর্তমানে মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতি ও রাজ পরিবারের যৌথ উদ্যোগে এই উৎসব হয়ে থাকে।

আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা উৎসব শুরু হয়। রথের আগের দিন রথের সামনে হয় বিশেষ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান যা ‘লেদ উৎসব’ বা ‘নেত্র উৎসব’ নামে পরিচিত। পরেরদিন নির্দিষ্ট সময় মেনে রথযাত্রা শুরু হয়। পূর্বে রাজ পরিবারের কোনো সদস্য রথের সামনে হাতির ওপর বসে রথ সঞ্চালনা করে নিয়ে যেতেন। এখন আর তা হয় না। এখন রাজ পরিবারের কোনো সদস্য পাল্কি চড়ে রথের সামনে আসেন। তিনি রথের দড়ি ছুঁয়ে প্রনাম করে রথযাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। এরপর রথের সারথির নির্দেশ মেনে হাজার হাজার মানুষ রথকে টেনে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গুণ্ডিচাবাটিতে নিয়ে যায়। সেখানে আটদিন রথ থাকে। এই আটদিন পুজা, পাঠ সহ নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। নবম দিনের দিন আবারও রথকে টেনে আগের জায়গায় নিয়ে আসা হয়। মহিষাদলের রথে জগন্নাথদেবের পাশাপাশি মদনগোপালজিউর মূর্তি থাকে। মেলা চলতে থাকে প্রায় মাসখানিক। বর্তমানে গড়ের ছোলাবাড়িতে মূল মেলা বসে।
সময়ের বহমান ধারায় মহিষাদলের রথ তার আগের জৌলুস অনেকটাই হারিয়েছে ঠিকই তবুও এই উৎসব নিয়ে মানুষের আবেগ, উন্মাদনা আজও বিদ্যমান। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের যে মিলনমেলা তা এলাকার সংস্কৃতি ও সংহতির বহমান ধারাকে আগামী সময়ে আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

তথ্যসূত্র :
মহিষাদল রাজবংশ – ভগবতীচরণ প্রধান
মহিষাদল ও রাজকাহিনী – বঙ্কিম ব্রহ্মচারী