ঝিঙে পটল (ধারাবাহিক, ত্রয়োদশ পর্ব) : দিলীপ রায় (+৯১ ৯৪৩৩৪৬২৮৫৪)।

সর্বনাশ ! স্কুলের সামনে বিরাট জটলা । আশেপাশের গাঁয়ের লোক ছুটছে । তাদের ভীষণ কৌতুহল ! শেষে কিনা স্কুলের ছাত্রীকে অপহরণ ! শক্তিপুর হাই স্কুলের ইতিহাসে অপহরণ এই প্রথম । সেটা নাকি নারী পাচার দলের কারসাজি !
অপহরণ কথাটা শুনে চমকে উঠল পটল । তাহলে কী তার বোন নারী পাচারকারী চক্রের শিকার ? মাথার ঠিক রাখতে পারছে না পটল । ভিড় সরিয়ে স্কুলে ঢোকামাত্র ঝিঙের বান্ধবী তিতলী এসে পটলকে জাপটে ধরলো, “দাদা, সর্বনাশ হয়ে গেছে ! ঝিঙেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ! বেয়াদপ দুর্বৃত্তরা তাকে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেছে ! এখনও পর্যন্ত হদিস নেই । থানাকে জানানো হয়েছে । থানার তল্লাশি চলছে । কিছুক্ষণ আগে থানার বড়বাবু এসেছিলেন । তিনি জানালেন, তাঁরা উপর মহলে ঘটনাটা জানিয়েছেন । পুলিশের বিশাল টীম জোরদার তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে । এখনও পর্যন্ত ঝিঙেকে খুঁজে পাওয়া যায়নি । কী হবে দাদা ?”
বোনের খবর শুনে পটল কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! দিশেহারা ! তার মাথায় কাজ করছে না । তার আহ্লাদের একমাত্র বোন নিখোঁজ ! নারী পাচারকারী চক্রের কবলে ! সে ভাবতেই পারছে না । বোনটা কারও সাতেপাঁচে থাকে না । তবে তার কেন এমন দুর্দশা ? পটলের চোখে জল । হাউ হাউ করে কান্না পাচ্ছে । কিন্তু নিজেকে সামলে সে ভাবলো, এখন কাঁদলে হবে না । কান্নাকাটি পরে হবে । আগে বোনকে উদ্ধার করা জ্রুরি ! এইজন্য স্কুলের হেড স্যারের সঙ্গে দেখা করতে ছুটলো পটল । স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা কেউ বাড়ি ফেরেননি ! সকলের চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতার ঘনঘটা ! তাঁরা ঝিঙের জন্য চিন্তিত । তাকে উদ্ধারের তৎপরতায় ব্যতিব্যস্ত । তাঁদের স্কুলের ইতিহাসে এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ইতিপূর্বে কখনও ঘটেনি ।
হেড স্যারের পা জড়িয়ে ধরলো পটল । তারপর তার কী কান্না !
“স্যার, আমার বোনকে ফিরিয়ে দিন । বোনটার মা-বাবা কেউ নেই । আমি তার কাছে “মা-বাবা-দাদা” সব । সুতরাং তাকে হারিয়ে আমিও বেঁচে থাকতে পারব না । আপনি আমার বোনটাকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিন ।“ পটলের কাতর আবেদন ।
হেড স্যার পটলকে সান্ত্বনা দিলেন । তারপর তিনি পটলকে হেড স্যারের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসালেন । হেড স্যার নিজেও ঝিঙের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন । তিনি শান্ত গলায় পটলকে বোঝালেন, “আমরা সমস্ত ঘটনা পুলিশকে জানিয়েছি । পুলিশ ঝিঙেকে উদ্ধারের জন্য খোঁজাখুঁজি করছেন । চারিদিকে তল্লাশি চলছে । স্কুলের কয়েকজন মাস্টার মশাই, বেশ কয়েকজন উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের নিয়ে নিজেদের মতো তল্লাশি চালাচ্ছেন । আপনার বোনকে আমরা শীঘ্র পেয়ে যাবো । একটু মনকে শক্ত করুন । ধৈর্য ধরুন । যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার বোনের হদিস না পাচ্ছি, আমরা স্কুল ছেড়ে নড়ছি না ।
ঠিক সেই মুহূর্তে থানার বড়বাবু এসে হাজির । হেড স্যারকে স্যালুট জানিয়ে বললেন, শুনলাম মেয়েটার দাদা এসেছেন । তদন্তের স্বার্থে তার সাথে আমাদের সাক্ষাৎ করা দরকার । বোনটার দৈনন্দিন জীবনের চালচলন নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ রয়েছে । আলোচনা প্রসঙ্গে তার নিখোঁজ হওয়ার যদি কিছু হদিস মেলে !
থানার বড়বাবু পটলকে একান্তে আড়ালে নিয়ে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলেন । বড়বাবু বারংবার যেটা জানতে চাইলেন, ঝিঙে কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিল কিনা ? যেটা দাদা হিসাবে অজানা ! সম্প্রতি কোনো ছেলে ছোকরা ঝিঙেকে উৎপাত করতো কিনা ? তা ছাড়া কোনো অপরিচিত ছেলের আনাগোনা লক্ষ্য করেছে কিনা ? পটল পুলিশকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলো, তার বোন কোনোরকম প্রেমের জালে জড়ায়নি । বোনের বিরূদ্ধে অন্তত প্রেম ভালবাসার কোনো ইস্যু নেই । পটলের মতে, তার বোনের কোনো শত্রু নেই । তাই থানার বড়বাবুকে পটল হাত জোড় করে বলল, স্যার, আমার বোনটাকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিন । নতুবা বোনকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারব না ।“
রাত্রির অন্ধকার ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে । চারিদিকে রটে গেল পটলের বোন ঝিঙেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । বাজারসৌ স্টেশন ছাড়িয়ে খবর পৌঁছে গেল গৌরীনগর, ঘোষপাড়ায় । ঘোষপাড়া থেকে ছুটে এলেন অদ্বৈতনাথ মোড়ল । গৌরীনগর থেকে গদাই খুড়ো, মনোহর কাকা অনেক মানুষজন নিয়ে স্কুলে হাজির । যত রাত বাড়ল, স্কুলে তত মানুষের ঢল বাড়লো । সকলের চোখে উদ্বেগের চাহনী ।
বাজারসৌ স্টেশন চত্বরের সকল দোকানদার দোকান বন্ধ করে হাই স্কুলে হাজির । খবর পৌঁছে গেল শুভ্রাংশবাবুর কাছে । সুদূর অসমের ডিব্রুগড়ে বসে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন । তিনি আগরওয়ালবাবুর মাধ্যমে লালবাজারে যোগাযোগ করলেন ।
পুলিশের তল্লাশির কথা জানতে পেরে, স্কুলে উপস্থিত মানুষের একটাই সান্ত্বনা এবার আসল দুর্বৃত্ত ধরা পড়তে বাধ্য ।
অদ্বৈতনাথ মোড়ল চুপ করে বসে রইলেন না । তিনি গাঁয়ের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই রাত্রিতে হাবু ডাকাতের বাড়ি ছুটলো । মনগড়া গাঁয়ের হাবু ডাকাতের নাম সবাই জনে । একসময় হাবু ডাকাতের দাপট ছিল অবর্ণনীয় । অদ্বৈতনাথ চিন্তা করলেন, হাবু ডাকাত তাঁদের অঞ্চলে নামকরা । যদিও ইদানীং তিনি আর পাপ কাজে যান না । তবে এলাকার অনৈতিক কাজগুলির ক্ষেত্রে হাবু ডাকাতের নজর থাকতে পারে । কেননা নারী পাচার চক্র এলাকার মানুষের যোগসাজসে সক্রিয় থাকলে নিশ্চয় তাঁর কাছে খবর থাকবে । রাতের অন্ধকারে সাইকেল নিয়ে মনগড়া গ্রামে গিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন হাবু ডাকাতকে ।
হাবু ডাকাতের আর দাপট নেই । এখন চুপচাপ বাড়িতেই সময় কাটায় । শীতকালে কতকগুলি খেঁজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ক’রে বেচাকেনা করে । তার ছেলেগুলি ভিন রাজ্যে সোনার কাজ করে । সংসারে তাঁর অভাব নেই । কিন্তু হাবু ডাকাতের মেজাজ এখনও সেই আগের মতো চড়া ।
হাবু ডাকাতকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন অদ্বৈতনাথ মোড়ল । তিনি শুনে মাথা চুলকালেন । তারপর অদ্বৈতনাথকে বললেন, আমি এখন ঘরে বসা । এদিক ওদিক যাতায়াত করি না । তুমি যখন আমার সাহায্য চাইছো, দেখি কতোটা কী করতে পারি । তবে এই জঘন্য কাজটা নিশ্চয় বাইরের লোকেদের কাজ । এই তল্লাটের ছেলেপেলে কখনই মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করবে না । ছিনিবিনি খেলবে না !
তারপর দল বেধে সুলতানপুরের মুলকানের বাড়িতে হাজির । হাবু ডাকাতের ধারণা, সুলতানপুরের মুলকান ঘটনাটা জানতে পারে । মুলকান না জানলে তাঁর কিচ্ছু করার নেই । সেই কারণে মুলকানের বাড়ি আসা ।
মুলকানকে ডাকার পরে প্রথমে তার বৌ ঘর থেকে বেরিয়ে হাবু ডাকাতকে বলল, “আপনি এত রাত্রিতে ?”
তুমি একটু মুলকানকে ডেকে দাও ?
সে ঘুমোচ্ছে !
তাকে ঘুম থেকে ডেকে দাও । বলো, হাবু চাচা এসেছে ।
মুলকান ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সমস্ত ঘটনা শুনে সে বলল, “আপনার আসতে দেরী হয়ে গেছে চাচা । সে শুনেছিল, ভিন রাজ্যের দল এলাকায় ঢুকেছে । উদ্দেশ্য, নারী পাচার । যদি তাদের ঝিঙেকে তুলে নিয়ে পালাবার অভিপ্রায় থাকে, তাহলে এতক্ষণ এয়ারপোর্টে ফ্লাইট ধরার অপেক্ষায় ! তাদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই । সে শুধুমাত্র ঘটনাটা শুনেছে ।“
“দলটি কোথাকার সেটা তুমি কী জানো ?” অদ্বৈতনাথ জিজ্ঞাসা করলেন ।
যতদূর জেনেছে, তারা নাগপুরের লোক । এদের কাজ, গ্রাম থেকে মেয়ে সংগ্রহ করা । তারপর ভিন দেশে পাচার করা ।
অদ্বৈতনাথ একরকম দ্রতগতিতে সাইকেল চালিয়ে ফিরে এসে খবরটা থানার বড়বাবুকে দিলেন । বড়বাবু উপর মহলে খবরটা জানিয়ে দিলেন । কিন্তু ঝিঙেকে নিয়ে তারা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো না । তার আগেই ডানকুনিতে ধরা পড়ল । অবশেষে ঝিঙেকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেল । পুলিশদের নিরলস প্রয়াসের অবসান !
তখন ভোর চারটে । আসল দুর্বৃত্তরা পালিয়ে এলাকা ছেড়ে উধাও । পুলিশের জালে যখন দুর্বৃত্তরা ধরা পড়ার উপক্রম সেই মুহূর্তে ঝিঙেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মারুতি ভ্যান গাড়িতে ফেলে দুর্বৃত্ততা উধাও । নিরুদ্দেশ !
পটল বোনকে ফিরে পেয়ে খুশীতে ভরপুর ।
 (চলবে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *